কিংকর গম্ভীর গলায় বলে, “ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করলে ভাল চোখে দেখতে বাধা কী?”
সাতনা বলে, “বাধা আছে। তোমার বাধা আছে। আমার সব কিছু মনে থাকে। মানুষের মুখ আমি সহজে ভুলি না।”
কিংকরের মুখটা আবার হিংস্র হয়ে ওঠে।
সাতনা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “কিছু বলতে হবে না। আমি মরদ কিনা সে-পরিচয় যথাসময়ে পাবে। এখন খ্যামা দাও। শুধু মনে রেখো সাতনার দশজোড়া চোখ সব জায়গায় তোমাকে নজরে রাখবে। দশজোড়া হাত তৈরি থাকবে। এক চুল বেয়াদবি দেখলে চোখের একটা ইশারা করব, সঙ্গে-সঙ্গে তোমার মুণ্ডু খসে পড়বে।”
কিংকর ঝাঁকুনি মেরে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাস্তবিকই পিছন থেকে আচমকা দশখানা বল্লমের তীক্ষ্ণ ডগা পিঠ আর কোমর স্পর্শ করল। কিংকর উঠল না। কিন্তু একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “খুব মরদ।”
সাতনা খুব বড় একটা শ্বাস টেনে বলল, “তোমার সাহস আছে বটে।”
.
৩০.
কোনো কথা না বলে দুখানা তীক্ষ্ণ চোখে অনেকক্ষণ কিংকরকে দেখল সাতনা। তারপর বলল, “তোমার বড্ড ঝুঁজ হে। ঝাজালো লোক আমি পছন্দ করি বটে, তবে বেশি ঝাজ ভাল নয়।”
কিংকর কথা বলল না। কটমট করে তাকিয়ে রইল। সাতনা একটা হাঁক দিলে এক স্যাঙাত দৌড়ে আসে। সাতনা তাকে বলে, “যা, রামুকে ধরে নিয়ে আয়।”
কিংকরের পিছনে দশখানা বল্লম উঁচিয়ে আছে। সে অবশ্য গ্রাহ্য করল। একমনে খেজুর রস খায় আর মাঝে-মাঝে সাতনার দিকে আগুনপারা। চোখ করে চায়।
একটু বাদেই নড়া ধরে রামুকে নিয়ে এল সাতনার স্যাঙাত। অল্প সময়ের মধ্যেই রামুর মুখ শুকিয়ে গেছে। চোখে আতঙ্ক। তাকে দেখে কিংকর সাতনার ওপর রাগে দাঁতে দাঁত পিষল।
সাতনা কিংকরকেই লক্ষ্য করছিল। একটু হেসে বল, “রাগ কোরো না হে। মায়াদয়া করলে আমাদের চলে না। ওহে রামু, এই লোকটাকে চেনো?”
রামু দিশাহারার মতো চারদিকে চেয়ে দেখল। তারপর কিংকরের দিকে তাকিয়ে বলল, “চিনি। এই লোকটাই কাল রাতে আমাদের ধরে এনেছে।”
সাতনা মাথা নেড়ে বলে, “সে তো জানি। সে-কথা নয়। লোকটাকে আগে থেকে চেনো কিনা ভাল করে দেখে বলো তো।”
রামু ভাল করেই দেখল। আবছা-আবছা একটা চেনা মানুষের আদল আসে বটে, কিন্তু সঠিক চিনতে পারল না। মাথা নেড়ে সে বলল, “চিনি না।”
“খুব ভাল করে দেখলে চিনতে পারতে কিন্তু। অবিশ্যি তোমার দোষ নেই। এই লোকটা হরবোলা। একসময়ে সার্কাসে হরেক রকম পাখি আর জানোয়ারের ডাক নকল করত। যে-কোনো মানুষের গলা একবার শুনে হুবহু সেই গলায় কইতে পারে। সুতরাং গলা শুনে একে চিনবে না। আর চেহারা? যে-চেহারাটা এখন দেখছ সেইটেও এর আসল চেহারা নয়, তবে অনেকটা কাছাকাছি। দরকার শুধু থিয়েটারের সঙ সাজার কয়েকটা জিনিস। তাহলেই হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…..”
সাতনা হাসতে হাসতে বেদম হয়ে পড়ল। কিংকর স্থির চোখেই সাতনার দিকে চেয়ে ছিল। কথা বলল না।
সাতনা হাসি থামিয়ে কিংকরের দিকে চেয়ে বলল, “তোমার অনেক গুণ। এত গুণ খামোখা নষ্ট করলে হে।”
কিংকর একটু হেসে বলে, “তোমারও অনেক গুণ। সেইসব গুণ তুমিও অকাজে নষ্ট করলে সাতনা। তবে বলি তোমার ক্ষতি করতে আমার আসা নয়। আমি তোমাকে দুটি কথা বলব। বেশ মন দিয়ে শোনো।”
সাতনা হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখ করে কিংকরের দিকে চাইল। তারপর বলল “শুধু গুল মেরে এই জাল কেটে বেরোতে পারবে না। কাজেই বলার আগে ভেবেচিন্তে নাও, যা বলবে তা সত্যি কিনা।”
“আমি যা বলব তা সত্যি। তবে এত লোকের সামনে বলা যাবে না। কথাটা বড়ই গোপন।”
সাতনা পাহাড় প্রমাণ শরীরটা টান করে উঠে দাঁড়াল। বলল, “ঠিক আছে। চোরকুঠুরিতে চলো। তবে তোমার হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা থাকবে।”
“ঠিক আছে। তাই-ই সই।”
“সার্কাসে তুমি হাতকড়া খোলার খেলা দেখাতে! আমার সব মনে আছে। কিন্তু এখন চালাকি করে হাতের দড়ি খুলতে যেও না আমার কাছে রিভলভার আছে। মনে রেখো।”
দুটো লোক এসে কিংকরের হাত পিছমোড়া দিয়ে শক্ত করে বাঁধল। তারপর সাতনা আর কিংকর গিয়ে ঢুকল চোরকুঠুরিতে।
কিংকরকে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে মুখোমুখি বসল সাতনা। হাতে সত্যিই ছ’ঘরা রিভলভার। বসে বলল, “যা বলার চটপট বলে ফ্যালো।”
“আমি কাকাতুয়াটাকে দিয়ে কথা বলাতে পারি।”
“পারো? বটে?” সাতনা একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।
কিংকর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “পারি। অনেক ভেবেচিন্তে কায়দাটা বের করেছি। কিন্তু পাখিটা কথা বললে তোমরা সেই গুপ্তধন বের করবে। অথচ ওই গুপ্তধন তোমাদের পাওনা নয়। আইন বলে, যত গুপ্তধন পাওয়া যাবে তার সবই গবর্মেন্টের। কিন্তু তোমরা গবর্মেন্টকে এক পয়সাও দেবে না।”
সাতনা জলদগম্ভীর স্বরে বলে, “শুধু এই কথা?”
“না। আরো আছে। গোবিন্দ ওস্তাদকে চেনো। বেচারা মিথ্যে খুনের মামলায় ফেঁসে গেছে। অথচ তা উচিত নয়। আসল খুনীর উচিত নিজের দোষ স্বীকার করে নির্দোষ লোকটাকে খালাস করে দেওয়া।”
সাতনার মুখ ফেটে পড়ছিল দুর্দান্ত রাগে। খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে বলল, “আর কিছু?”
“হ্যাঁ। আর একটা কথা। তোমার যে-মেয়েটা হারিয়ে গিয়েছিল, আমি তার সন্ধান জানি। সে যে তোমারই মেয়ে তার প্রমাণও দিতে পারি।“
আস্তে-আস্তে, খুব আস্তে-আস্তে সাতনার মুখে একটা পরিবর্তন ঘটতে লাগল। কর্কশ, নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর মুখোনা যেন কোমল হতে লাগল। চোখ দুটো ভরে উঠল জলে। একটা দমকা শ্বাসের সঙ্গে অস্ফুট গলায় সে বলল, “মিথ্যে কথা!” একটু থেমে আবার বলল, “মিথ্যে কথা! তুই আমাকে ভোলাতে এসেছিস।”