সাতনা এতটুকু চঞ্চল হল না। শুধু প্রকাণ্ড একখানা হাত বাড়িয়ে কিংকরের পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বলল, “সাবাশ। বহোত খুব।”
কিংকর এই বাহবায় গলল না। চিতাবাঘের মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা ডাকাত না ছুঁচো? কাপুরুষের দল! বাচ্চাদের যারা খুন করে, তারা কখনো মরদ নয়।”
সাতনা একটু হাসল। তারপর মোলায়েম গলায় বলল, “রামুকে খুন করা হত না হে। তোমাকে একটু পরীক্ষা করার জন্য ওটুকু অভিনয় করতে হল।”
কিংকর ফুঁসে উঠে বলল, “কিসের পরীক্ষা? তোমাদের মতো চুনোপুঁটির কাছে পরীক্ষা দিতে হবে আমাকে তেমন ঠাউরেছ নাকি?”
সাতনা ঠাণ্ডা গলায় বলে, “আহা চটো কেন ভায়া! তুমি ভিন দলের লোক না শত্রুপক্ষের চর তা একটু বাজিয়ে দেখতে হবে না?”
কিংকর চোখ রাঙা করে তেজের গলায় বলল, “দেখ সাতনা, যতদূর জানি তুমি এ-দলের সামান্য মোড়ল মাত্র। সর্দার অন্ত্রিকবাবা কাল তোমাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছিল না। বেশি ফেঁপরদালালি করবে তো সোজা সর্দারকে জানিয়ে দেব। আর একটা কথা, তোমার চেহারাটা বড়সড় বটে, ভোবো না বেড়ালের মতো তোমার নটা প্রাণ আছে। এ দুখানা শুধু-হাতে তোমার ওই মোষে গর্দান ভেজা-গামছার মতো নিংড়ে মুচকে দিতে পারি। কাজেই বুঝে-সমঝে চলো। আমি তোমার পালের মেড়াদের মতো নাই।”
সাতনার সঙ্গে এই ভাষায় এবং তেজের ভঙ্গিতে কেউ কথা কওয়ার সাহস পায় না। কিন্তু এই অগ্রাহ্যের ভাব সাতনা মুখ বুজে সয়ে গেল। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি একটা ছেলেকে চিনতাম। তখন তার অল্প বয়স। ইসকুলে পড়ে। প্রতি বছর ইসকুলের স্পোর্টসে ছেলেটা জ্যাভেলিন থ্রোয়ে সেরা প্রাইজ পেত। বর্শা ছুঁড়ত এমন জোরে যে দেখে তাক লেগে যেত। বেঁচে থাকলে এখন সে তোমার বয়সীই হয়েছে।”
এ-কথা শুনে কিংকর একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তবু তেজের সঙ্গে বলল, “ওসব এলেবেলে কথা শুনতে চাই না। এবার থেকে কিংকরকে একটু সমঝে চলো।”
দুজন লোক বল্লম-খাওয়া লোকটাকে ধরাধরি করে চাতালে এনে ফেলল। মুখে জল দেওয়া হচ্ছে রক্তে ভাসাভাসি কাণ্ড। চোট গুরুতর। তবে কাঁধে লেগেছে বলে প্রাণের ভয় নেই। সাতনার স্যাঙাতরা কটমট করে কিংকরের দিকে তাকাচ্ছে, একটু ইঙ্গিত পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা নামিয়ে দেবে।
কিন্তু সাতনা তাদের দিকে তাকাল না। কিংকরকে বলল, “চলো, ভিতর বাড়িতে যাই। ভয় নেই, রামুকে কেউ এখনই খুন করবে না।”
কিংকর বলল, “না-করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ওই বাচ্চা-ছেলেটার গায়ে কেউ হাত তুলেছে বলে যদি টের পাই তবে সেই হাত আমি কেটে ফেলে দেব মনে রেখো।”
“বাপ রে!” বলে সাতনা হাসল, “তুমি যে আমাকে ভয় খাইয়ে দিচ্ছ।”
এ-কথায় কিংকরও হেসে ফেলল। তারপর ভিতরবাড়িতে গিয়ে উঠোনের রোদে দুজনে দুটো দড়ির চারপাইতে বসে খেজুর রস খেতে লাগল। কিংকর জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ আমাকে পরীক্ষা করার জন্য ওই ছেলেটাকে সাতসকালে খুনেদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলে কেন?”
সাতনা প্রথমটায় কথা বলল না। একমনে খেজুর রস খেয়ে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ বাদে বলল, “দেখছিলাম ওই ছেলেটার প্রতি তোমার দরদ আছে কি না।”
কিংকর অবাক হয়ে বলল, থাকবে না কেন? ডাকাতি করি বলে তো আর অমানুষ নই।”
সাতনা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, বলল, “তোমাকে যে সেই ছেলেটার কথা বলছিলাম, যে ইসকুলে জ্যাভেলিন থ্রোতে প্রতিবার ফার্স্ট হত, তার কথা আর একটু শুনবে নাকি?”
কিংকর একটু থতমত খেয়ে বলে, “তার মানে? তোমার কি মাথার গণ্ডগোল আছে নাকি বাপু? হঠাৎ পুরনো গপ্পো ফেঁদে বসতে চাইছ কেন?”
“সাধে কি আর চাইছি? গপ্পোটা তোমার জানা দরকার। এমনও তো হতে পারে যে, সেই ছেলেটাই তুমি।”
কিংকর হাতের রসসুষ্ঠু ভাঁড়টা হঠাৎ ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ ধকধক করছে, লম্বা শরীরের পেশীগুলো জামার তলায় ঠেলাঠেলি করছে! থমথমে গলায় সে বলে, “সাতনা, বুঝতে পারছি খামোখা আমাকে ঝামেলায় জড়িয়ে, সকলের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুমি আমাকে দল থেকে হঠাতে চাইছ। কারণ আমি থাকলে এই দলে তোমার জায়গা আমার নীচেই হবে। তাই বলছি, ওসব হীন চক্রান্ত না করে এসো দুজনে মরদের মতো ফয়সালা করে নিই কে কত বড় ওস্তাদ। হাতিয়ার ধরতে হয় তো ধরো, নইলে খালি হাতে চাও তো তাই হোক। চলে এসো।”
এই চ্যালেঞ্জের জবাবে কিন্তু সাতনা নড়ল না। কেমন একরকম ক্যাবলা চোখে কিছুক্ষণ কিংকরের দিকে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, “বোস কিংকর। না, তোমার সঙ্গে আমি কাজিয়া করতে চাই না। বোসো কথা আছে।”
রাগে ফুলতে ফুলতে কিংকর আবার চারপাইতে বসল।
সাতনা বলল, “তুমি খুব সাংঘাতিক লোক, মেনে নিচ্ছি। কিন্তু মনে রেখো, তোমারও একটা বৈ দুটো প্রাণ নেই।”
“ জানি। ওসব ভয় আমাকে দেখিও না। কিংকরের একটাই জান বটে, কিন্তু সেটা মরদের জান। তোমার জান নয়। আমাকে প্রাণের ভয় দেখিয়ো না।”
এতেও উত্তেজিত হল না সাতনা। শান্ত গলায় বলল, “তোমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। জানি। সে-চেষ্টা করছি না। শুধু জানতে চাইছি তুমি এ-দলে ঢুকলে কেন? তুমি তোমার মতো থাকো।”
সাতনা মাথা নেড়ে বলে, “তা থাকতে পারছি কই? তুমি কথায়-কথায় আমাকে শাসাচ্ছ, লড়তে চাইছ। তার মানে ছুতোনাতায় আমার সঙ্গে তোমার লাগবেই। তাই মনে হয় তুমি আমাকে ভাল চোখে দেখতে পারছ না।”