“দূর বেটা খণ্ডিত সত্তা, তোরা হলি সংসার-পুকুরের মাছ। অমৃতের স্বাদ কি একেবারে পাবি? তবু তো তোর কমলালেবুর রস বলে মনে হয়েছে, অনেকের আবার ডাবের জল বা এমনি জল বলে মনে হয়েছে। তারা ঘোর পাপী, ঘোর পাপী, ব্যোম ব্যোম হর হর…”
নয়ন আর একবার সাধুকে প্রণাম করে।
সাধু কাকাতুয়ার দাঁড়টার দিকে তাকিয়ে ফেঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে “নিজেরা হাজারো মায়ায় আটকে ছটফট করছিস তার ওপর ঐ অবোলা জীবটার পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিস! ঘোর নরকে যাবি।
“আমি নই বাবা! ও হল কর্তাবাবুর পাখি। আমি সামান্য চাকর।
“যে বেটা নিজেকে চাকর ভাবে, সে তো আগাপাশতলা চাকরই। নিজেকে চাকর ভাবিস কেন? তুই তো মুক্ত আত্মা। এ-বাড়ি এ-সংসার এ-দুনিয়ার সব কিছুর মালিক। যা বেটা ছেড়ে দে পাখিটাকে যা যা, ওঠ, দেরি করিসনি।”
নয়ন ভয়ে-ভয়ে উঠে পড়ে বলে, “কিন্তু বাবা, কর্তাবাবু রাগী লোক। ফিরে এসে পাখি না দেখলে এমন কুরুক্ষেত্র করবে!”
চোখ পাকিয়ে সাধু হুহুংকার দিয়ে ওঠে। “হর হর ব্যোম ব্যোম….কে তোর কেশাগ্র স্পর্শ করবে রে বেটা? এইমাত্র অমৃত খেলি যে! যা বেটা, ছেড়ে দে, একটা মুক্ত আকাশের জীবকে আর কষ্ট দিসনে। ছেড়ে দে, উড়ে যাক।”
নয়নকাজল সাধুর হুংকারে মনস্থির করতে না-পেরে দোনোমোনো হয়ে উঠে পড়ল। দাঁড়ের কাছে গিয়ে শিকলিটা খুলতে সবে হাত বাড়িয়েছে এমন সময় আর-একটা লোক বারান্দায় উঠে বিকট গলায় বলে উঠল, “কাকাতুয়ার
মাথায় ঝুঁটি, খ্যাকশিয়ালি পালায় ছুটি……।
নয়নকাজল এই দু নম্বর চেঁচানিতে ঘাবড়ে গেল। শিকল আর খোলা হল না। তাকিয়ে দেখল, মূর্তিমান গবা পাগলা।
গবা খুব সরু চোখ করে আপাদমস্তক সাধুকে দেখে নিচ্ছিল। ভাল করে দেখে-টেখে বলল, “সব ঠিক আছে। তবে বাবু, তোমার একটা ভুল হয়েছে। গায়ে ছাই মাখোনি।”
সাধু একটু হতভম্ব। কথা সরছে না। তবু একবার রণহুংকার দিল, “হর হর ব্যোম ব্যোম……”
গবা সেই হুংকারে একটুও না ঘাবড়ে বলে, “পায়ে বাটা কোম্পানির চটি জোড়াও মানায়নি একদম। একজোড়া কাঠের খরম যোগাড় করতে পারোনি হে?”
সাধু এবার একটু ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, “হর হর……”
গবা সাধুর বাঁ হাতটা তুলে কবজিটা দেখে নিয়ে বলে, “এ যে ঘড়ি পরার স্পষ্ট দাগ গো! রোজ ঘড়ি পরো বুঝি হাতে? সাধুরা আজকাল ঘড়িও পরেছ তাহলে? তা সেটা রেখে এলে কোথায়?”
সাধু ত্রিশূলটা শক্ত করে চেপে ধরে ধমক দেয়, “ব্যোম ব্যোম…”
গবা ফিক করে হেসে বলে, “বোমা কেন? পিস্তল নেই? বোমার চেয়ে পিস্তল ভাল। বোমা অনেক সময় ঝোলার মধ্যে ফেটে টেটে যেতে পারে।”
সাধু এক ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “ঘোর পাপী, ঘোর পাপী। অন্ধকারে ডুবে আছিস।”
পাখিটা অনেকক্ষণ ধরে সাধুকে ঘাড় কাত করে করে দেখছিল আর দাঁড়ে এধার-ওধার করছিল। এখন একটা ডিগবাজি খেয়ে বলল, বিশু, বিশু, আমারা কেন ঘুম পাচ্ছে! ঘুম পাচ্ছে! আলমারিতে টাকা নেই। টাকা আছে……”
সাধু হঠাৎ একটা লাফ মেরে বারান্দায় উঠে দাঁড়টাকে একটা ঝাঁকুনি মেরে বলে, “বল বেটা কোথায় আছে! বল নইলে গলা টিপে খুন করে ফেলব।”
পাখিটা হঠাৎ কঁকনি খেয়ে বুলি ভুলে ডানা ঝাঁপটে ভয়ে চিৎকার করতে লাগল।
.
০৩.
সাধুর কাণ্ড দেখে নয়নকাজলের বাকি সরে না, হাত-পা নড়ে, শরীরে সাড়া নেই। বড় বড় চোখে চেয়ে আছে। মুখোনা হাঁ। পাখিটা বুলি ভুলে গাঁ গাঁ করে প্রাণভয়ে চেঁচাচ্ছে আরদাঁড়ে বনবন করে ডিগবাজি খাচ্ছে। বিটকেল গলায় সাধু বলছে, “বল বেটা বল কোথায় টাকা! বল!”
অবস্থা যখন এইরকম গুরুচরণ, তখন হঠাৎ–জলের চৌবাচ্চায় নেমে বৈজ্ঞানিক আর্কিমিডিস আপেক্ষিক গুরুত্ব আবিষ্কার করার পর যেমন ইউরেকা ইউরেকা’ বলে আওয়াজ ছেড়েছিলেন–তেমনি গবা পাগলা লাফিয়ে উঠে দু’হাত তুলে নাচতে নাচতে চেঁচাতে লাগল’ চিনেছি! চিনেছি! সাধুকে চিনেছি!”
যেই না চেঁচানো সেই না সাধু চোখের পলকে লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে হাওয়ার বেগে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
নয়নকাজল ধাতস্থ হয়ে গবাকে জিজ্ঞেস করে, “বিটকেল সাধুটাকে চেনো হলে! কে বলো তো?
গবা বসে-বসে ঘাম মুখের ধুলো-ময়লা মুছছিল। বিজ্ঞের মতো হেসে বলল, “বলব কেন? ডবল লেন্স লাগিয়ে নতুন ধরনের একটা টর্চবাতি বানাব বলে তোমার কাছে যে গতকাল বাবুর মায়ের পুরনো চশমাজোড়া চাইলাম, দিয়েছিলে?”
নয়ন একটু তেড়িয়া হয়ে বলে, “আর চোর বলে যদি আমার বদনাম রটত? তখন তুমি কোথায় থাকতে?”
“চোর!” বলে হোঃ হোঃ করে হাসে গবা, “চোর বুঝি এখন নও? কুন্দ দারোগাকে যদি তোমার আসল নামটা জানাই তাহলে তুমি এরকম সুখে আর থাকবে না হে!”
একথা শুনে নয়ন কেমন একধারা হয়ে গেল। মুখোনা ছাইবর্ণ, চোখে জুলজুলে চাউনি।
গবা অবশ্য আর ঘাটাল না। বলল, “নাও, মেলা বেলা হয়েছে, পাঁচক ঠাকুরকে আমার খাবারটা বাড়তে বলো গে।”
নয়নকাজল মিনমিনে গলায় বলল, “যাচ্ছি। কিন্তু কথাটা হল–”
গবা হাত তুলে বলে, “বলতে হবে না। কথাটা আপাতত চাপা থাকবে। এখন নিশ্চিন্ত মনে যাও। আর শোনো, পাখিটাকে ভিতরের দরদালানে ঝুলিয়ে রেখো, যখন-তখন বের কোরো না, এটার ওপর কিছু লোকের চোখ আছে।”
নয়নকাজল দাঁড়টা নিয়ে ভিতরবাড়িতে চলে গেল।
এ-বাড়িতে গবা পাগলার আস্তানা বহুদিনের। মাঝেমধ্যে সে দু-চার ছ মাসের জন্য হাওয়া হয়ে যায় বটে, কিন্তু ফিরে এসে বাইরের পাকা চণ্ডীমন্ডপের পাশে রসুইখানার ঘরটায় বরাবরের মতো থানা গাড়ে। তাকে কেউ কিছু বলে না। শোনা যায় উদ্ধববাবু গবাকে একটা বিচ্ছিরি মামলা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। বহুকাল আগেকার কথা। সত্যি-মিথ্যে কেউ বলতে পারেনা।