লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় পালাচ্ছিলে তোমরা?” নয়ন মাথা চুলকে বলল, “ঠিক পালাচ্ছিলাম না।”
“তাহলে কি এত রাতে জঙ্গলে বেড়াতে বেরিয়েছিলে?”
নয়ন একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে অনেকটা তাই, দিনকাল ভাল নয়। চারদিকে চোর-ছ্যাচড়ের উৎপাত। তাই চারদিকটায় একটু নজর রাখছিলাম আর কী।”
“এই জঙ্গলে চোর-ছ্যাচড় কী করতে আসবে?” ও লোকটা একটু অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে।
নয়ন বিগলিত হয়ে বলে, “বলা তো যায় না আজ্ঞে। আমাদের আড্ডায় তো মেলাই দামি জিনিস আছে।”
লোকটা এবার একটু আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, “তোমাদের একটা আচ্ছা আছে নাকি এখানে? তা সে আচ্ছাটা কোথায়?”
নয়ন ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে ঘন ঘন মাথা চুলকোতে থাকে। রামু বলে, “কেন, আপনি কি সাতনা ডাকাতের আড্ডা চেনেন না?”
লোকটা এবার উৎসাহে একহাত এগিয়ে আসে। চাপা গলায় বলে, “আরে, আমিও যে সেই আড্ডাটাই খুঁজতে বেরিয়েছি। জায়গাটা কোথায় বলো তো?”
রামু মাথা নেড়ে বলে, “তা আমরাও জানি না। আমরা সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। জঙ্গলের রাস্তা চিনি না। ফিরে যাওয়ার পথ বলতে পারব না।”
লোকটা বলে, “তোমরা পালিয়ে এসেছ কেন? তোমাদের কি ওরা ধরে রেখেছিল?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার নাম কি রামু, উদ্ধববাবুর ছেলে তুমি?”
“হ্যাঁ।” রামু ভয়ে ভয়ে বলে।
লোকটা একটু হাসে। বলে, “আচ্ছা কাণ্ড যা হোক। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা ওদের দলেরই লোক।”
“আপনি কে?”
“আমাকে চিনবে না। আমি ডাকাতদের দলে নাম লেখাতে যাচ্ছি।”
নয়ন ফস করে বলে ওঠে, “সে তো আমিও গিয়েছিলুম। কিন্তু ওরা নতুন লোককে সহজে দলে নেয় না।”
লোকটা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, “নেবে। এলেমদার লোক দেখলে ঠিকই নেবে। তোমরা যদি কেবল পথটা বাতলে দিতে পারতে তাহলে আমার অনেক হয়রানি কমে যেত।”
নয়ন একটু গুম হয়ে থেকে বলল, “আপনি কেমন লোক কে জানে। খুব ভাল লোক যে নন তা বোঝাই যাচ্ছে। লোক আমিও ভাল নই। তাই আপনাকে বলতে বাধা নেই। আমার মনে হচ্ছে এই পশ্চিম দিকে নাক বরাবর এগোলে সেই আড্ডায় পৌঁছে যেতে পারবেন। তবে সাবধান, আচমকা বল্লম এসে বুকে বিঁধতে পারে। মাথায় লাঠি পড়তে পারে কিংবা ঘাড়ে রামদা’এর কোপ। ওরা বাইরের লোক পছন্দ করে না।”
লোকটা হেসে বলল, “কিন্তু তুমি তো ওদের দলের লোক।”
“না, আমি দল ছেড়ে পালাচ্ছি।”
“তাই কি হয়?” বলে লোকটা সাদা দাঁতে হাসতে-হাসতে উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “তোমরা পালালে আমার এত পরিশ্রমই বৃথা যাবে। আমি তোমাদের ধরে আবার সাতনার আস্তানায় নিয়ে যাব চলো।”
নয়ন ভয়ে আঁতকে উঠে বলল, “বলেন কী? এই তো গত পরশু সানার এক কসাই আমাকে বিষ-বিছুটি দিয়ে ছেড়েছে। আবার সেখানে যাব?”
রামুও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, “আপনি ডাকাত হতে যাচ্ছেন তো যান, আমাদের টানছেন কেন?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “তোমাদের ধরে নিয়ে গেলে সাতনা চট করে আমার ওপর খুশি হয়ে যাবে। তাছাড়া দলের ঘাঁতঘোঁতও কিছু তোমাদের কাছে জানার আছে আমার। আর দেরি করে লাভ নেই। ওঠো, উঠে পড়ো।”
নয়ন লোকটার পায়ে ধরার চেষ্টা করল। রামুও কঁদো-কাঁদো হয়ে অনেক কথা বলল। কিন্তু লোকটার নরম হওয়ার নাম নেই। খেটে লাঠিদুটো বগলে নিয়ে বল্লম বাগিয়ে সে একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে বলল, “নাকি কান্না বন্ধ করো। তোমাদের এত সহজে ছাড়ছি না।”
অগত্যা বল্লমের মৃদু খোঁচা খেতে-খেতে দুজনে ম্লানমুখে লোকটার আগে আগে পশ্চিমদিকে হাঁটতে লাগল।
বেশি দূর হাঁটতে হল না। আধ-মাইলটাক হাঁটতেই অন্ধকারে বিশাল বাড়িটা দেখা গেল। আর দেখা গেল মশাল হাতে বিশ-ত্রিশজন লোক ছোটাছুটি হাঁকাহাঁকি করছে।
লোকটা বলল, “ওই বোধহয় সেই আড্ডা?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। যমদুয়ার।” নয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।
আচমকা পিছন থেকে লোকটা একটা অমানুষিক “রে-রে-রে-রে” হাক ছাড়ল। সে এমন শব্দ যে মাটি কেঁপে ওঠে, গাছপালা নড়তে থাকে, দুর্বল লোকের হৃদপিণ্ড থেমে যায়। কোনো কথা নয়, শুধু “রে-রে-রে-রে” শব্দ বজ্রনির্ঘোষের মতো বেজে ওঠে।
সেই শব্দে মশালগুলো স্থির হয়ে দাঁড়াল। তার পর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল।
.
২৮.
মশালের আলোয় সবার আগে সাত ফুট লম্বা সাতনাকে দেখা গেল এগিয়ে আসতে। হাতে টাঙ্গি। ভয় খেয়ে নয়নকাজল রামুর হাত চেপে ধরে বলল, “আর রক্ষে নেই। দেশে আমার বিধবা মাকে একটা খবর পাঠিয়ে দিও ছোটদাদাবাবু।”
রামু অত ঘাবড়ায়নি। সে তো জানে কাকাতুয়াটাকে দিয়ে এখনো আসল কথা বলাতে পারেনি এরা।
দলটা কাছে এগিয়ে আসতেই দুটো মুশকো চেহারার লোক এসে খপাখপ রামু আর নয়নকাজলকে ধরে পিছমোড়া করে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল।
সাতনা গমগমে গলায় লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কে রে?”
লোকটা বেশ বুক চিতিয়েই জবাব দিল, “আমার নাম কিংকর। তুমি কেডা?”
“আমি সাতনা সর্দার।”
“ওঃ, তুমিই!” বলে লোকটা একটু হাসল। তারপর বলল “তোমার দলেই নাম লেখাতে এসেছি। আমি বর্ধমানের শংকর মাঝির শাকরেদ। নাম শুনেছ?”
“শংকর মাঝি।”
সাতনার গলায় রীতিমত ভক্তিশ্রদ্ধা ফুটে উঠল। ধরা গলায় বলল, “এ দলে আসবে নাকি?”
“হচ্ছে তো তাই।” বলে লোকটা জামার বুকপকেট থেকে বের করে সাতনার হাতে দিয়ে বলল, “এই হল শংকর মাঝির পাঞ্জা। বাঁকরো, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া যেখানে খুশি যে-কোনো দলে এই পাঞ্জা দেখালেই লুফে নেবে আমাকে। তবু তোমার দলেই এলাম কেন জানো? শুনেছি তোমরা একটা বড় দাও মারার ফন্দি এঁটেছ। সত্যি নাকি?”