সে যে পালাতে পারে, এটা নিশ্চয়ই কারো মাথায় আসেনি। এলে আরো ভাল পাহারা রাখত। কিন্তু পাহারা নেই। তা বলে পালানোও সহজ নয়। চারদিকে ঘন গাছপালা। নিবিড় জঙ্গল। তারা রাস্তা চেনে না।
‘নয়নদা, কোনদিকে যাবে?”
“তাই তো ভাবছি। চলো এগোই যেদিকে হোক। এখানে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয়।”
“চলো।” বলে রামু এগাতে থাকে।
কিন্তু এগোনো খুবই শক্ত। শীতকাল বলে সাপের ভয় নেই তেমন। কিন্তু লতাপাতায় পা আটকে যায়। হঠাৎ-হঠাৎ পাখি ডেকে ওঠে।
দুর্গের মতো বিশাল বাড়িটার চৌহদ্দি বড় কমও নয়। খানিকদূর এগোনোর পর সামনে আর-একটা ভাঙা দালান। সেই দালানের একটা ঘর থেকে টেমির আলো আসছে বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে।
নয়ন রামুর হাত চেপে ধরে বলল, “সর্বনাশ! শিগগির অন্য পথে চলো।” রামু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “যাব, একটু উঁকি দিয়ে যাই।”
“পাগল হয়েছ?”
হঠাৎ কাছে-পিঠে একটা ঘোড়া পা দাপিয়ে চিহিহি করে ডেকে উঠল। দুজনেই সেই শব্দে চমকে ওঠে।
“রামু, লক্ষণ ভাল নয়।”
“তুমি চুপ করো তো নয়নদা। অত ঘাবড়ে যাও কেন?”
রামু নিঃসাড়ে গিয়ে জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়। উঁকি মেরে ভিতরে তাকিয়ে তার রক্ত জল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। একটা চৌকির ওপর কম্বলের আসনে বিশাল চেহারার এক কাপালিক বসা। তার মস্ত জটাজুট, বিশাল কালো দাড়ি-গোঁফ, কপালে সিঁদুরের ধ্যাবড়া টিপ। গায়ে লাল পোক। তার সামনে বিনীত ভাবে দাঁড়িয়ে সাতনা।
নয়ন ডাকল, “রামু! পালাও!” রামু আর দাঁড়াল না, নয়ন আর সে প্রাণপণে দৌড়তে লাগল।
কতবার যে পড়ল দুজনে, কতবার ফের উঠল, তার হিসেব নেই। গাছের সঙ্গে বার-সতেক ধাক্কা খেল। পা-হাত ছড়ে গেল, কপাল ফুলে উঠল। তবু তারা দৌড়তে থাকে।
খানিকটা দূর দৌড়োবার পরই তারা বুঝতে পারে, পিছনে কারো হাঁকডাক নেই বটে, কিন্তু কেউ তাদের পিছু নিয়েছে ঠিকই। তারা যেদিকে যাচ্ছে, পায়ের একটা শব্দও সেদিকেই তাদের পিছু নিচ্ছে।
“নয়নদা, পিছনে কেউ আসছে।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে।”
.
২৭.
রামু বলল, “বড় হাঁফিয়ে গেছি।”
নয়ন বলল, “আমিও। এসো, বসে একটু জিরিয়ে নিই।”
ফিসফিস করে নয়ন বলে, “আসছে আমাদের পায়ের শব্দ শুনে-শুনে। নইলে এই জঙ্গলে আমাদের পিছু নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। যদি বসে থাকি, তবে আমাদের পায়ের শব্দও হবে না, আর লোকটাও খুঁজে পাবে না আমাদের।”
বলতে-বলতে নয়ন বসে দম নিতে থাকে। রামুও। পিছনে পায়ের শব্দটাও আর হচ্ছে না।
রামু জিজ্ঞেস করে, “আমরা কতদূর এসেছি নয়নদা?”
“তা কী করে বলব? এ-জায়গা আমার চেনা নয়। জঙ্গলটাও ভারী জটিল। শুনেছি পুবধারে একটা দুর্ভেদ্য বাঁশবন আছে। সেই বন এত ঘন যে, শেয়ালও গলতে পারে না।”
“আমরা কি সেদিকেই যাচ্ছি?”
“তাও জানি না। আমরা খুব বেশি দূর আসতে পারিনি। ছুটবার সময় ডাকাতদের রাতপাহারার একটা হাঁক-ডাক শুনতে পেলাম যেন।”
রামু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে চলো, আর-একটু দূরে যাই।”
নয়ন তার হাতখানা ধরে বসিয়ে দিয়ে কাহিল গলায় বলল, “খামোখা হয়রাণ হয়ে লাভ কী? গোলকধাঁধায় পড়ে আবার হয়তো গিয়ে ডাকাতদের আচ্ছায় হাজির হতে হবে। তার চেয়ে বসে থাকো। ভোর হলে আলোয় আলোয় চলে যাব।”
রামু জিজ্ঞেস করে, “কাপালিকটাকে দেখলে?”
“ভাল করে দেখিনি। যা ভয় পেয়েছিলাম।”
রামু একটা শ্বাস ফেলে বলল, “বিশাল চেহারা। ভাবসাব দেখে মনে হল সাতনাও ওকে খাতির করে।”
“তা হলে ও হল সাতনার ওপরের সর্দার। এ-দলে যে কে কোন্ পোস্টে আছে, তা বলা মুশকিল।”
“তান্ত্রিক কাপালিকরা কি ডাকাত হয়?”
“হাতে পারে। তা ছাড়া আসল কাপালিক কি না তাই দ্যাখো, ভেকও থাকতে পারে।”
যেখানে তারা বসে আছে, সে-জায়গাটায় গাছপালা তেমন ঘন নয়। শীতে গাছপালার পাতা ঝরে এমনিতেও একটু হাল্কা হয়েছে জঙ্গল। অন্ধকারে গাছপালা চেনা যায়, না, তবে এখানকার গাছগুলো সবই বড়-বড়। ঝোঁপঝাড় তেমন নেই। লম্বা ঘাসের ও আছে অবশ্য। তারা তেমনি বুক-সমান ঘাসের মধ্যেই বসে আছে। হাত বাড়ালে একটা শিশুগাছের গুঁড়ি ছোঁয়া যায়।
হঠাৎ রামু বলল, “একটা শব্দ পেলে নয়নদা?”
নয়ন একটু শক্ত হয়ে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, একটু একটু পাচ্ছি। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কেউ আসছে।
রামু বলল, “আসছে নয়, এসে গেছে। ওঠো নয়নদা, ছোটো।”
প্রাণের দায়ে নয়ন উঠল। কিন্তু ছুটতে গিয়েই ঘটল বিপদটা। কোত্থেকে একটা খেটে লাঠি ছিটকে এসে তার দুই পায়ের মধ্যে একটা ডিগবাজী খেল। তাইতে নয়ন পড়ল উপুড় হয়ে। আর একটা খেটে লাঠির পাল্লায় পড়ে রামুও চিতপটাং।
শিশুগাছের পিছন থেকে লোকটা ধীরে-সুস্থে বেরিয়ে এল। হাতে বল্লম। অন্য হাতে নড়া ধরে প্রথমে রামুকে দাঁড় করাল। ছোট্ট একটা চড় তার গালে কষিয়ে গমগমে গলায় বলল, “পালাতে চাইবে আর? ওই খেটে লাঠির ক্ষমতা জানো? এককালে ঠ্যাঙাড়ে ঠগীরা ওই দিয়ে দূর থেকে লোককে ঘায়েল করত। ফের যদি পালাও তো পাবড়া দিয়ে ঠ্যাং ভেঙে দেব।”
রামুর অবশ্য পালানোর মতো অবস্থা নয়। চড়টা খেয়ে তার মাথা ঘুরছে। সে উবু হয়ে বসে পড়ল।
নয়নকাজল আর ট্যাফো করল না। শোয়া অবস্থাতেই লোকটার পায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আজ্ঞে আর পালাব না।”
নোকটা দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে নিজেও মুখোমুখি বসল। অন্ধকারে আবছা যা দেখা যায় তাতে বোঝা যাচ্ছে লোকটার বয়স বেশি নয়। হালকা পলকা চেহারা বটে, কিন্তু গায়ে পেশ জোর রাখে। পরনে মালকোচামারা। ধুতি, গায়ে একটা বালাপোশের খাটো কোট, পায়ে নাগরা।