দালানের মধ্যে তেমন পাহারা নেই। পাহারা আছে বাড়ির চারধারে। কোনো দরজা বা ফটক দিয়ে বেরোনোর উপায় নেই। আর নীচের তলার দোর দিয়ে অনেক লোক ঘুমোচ্ছে। দোতলাতে গোটা দুই-তিনঘরে লোক আছে। সাড়াশব্দ হলে তারা জেগে যেতে পারে।
নয়ন পা টিপে টিপে ছাদে উঠল। আজও কুয়াশা আছে, শীতও সাংঘাতিক। তবে মাঝরাতে একটু চাঁদের উদয় হয়ে থাকবে। অন্ধকারটা তেমন জমাট নয়। একটু ফিকে ভাব। মস্ত ছাদখানা অনেকটা দেখা যাচ্ছে। বিস্তর আজে বাজে জিনিস, পড়ে আছে ছাদে। পুরনো পিপে, পাথরের মূর্তি, ইট, ভাঙা দরজা-জানালার কাঠ।
নয়ন ঠাহর করে রামুর ঘরটা কোথায় তা আন্দাজ করল। রেলিং দিয়ে ফুঁকতে নীচের দিকে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল তার। এই এত উঁচু থেকে যদি পড়ে যায় তো মাথাটি আস্ত থাকবে না। অনেকক্ষণ চোখ বুজে একটু ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করল সে।
তারপর চোখ খুলতেই বুকের মধ্যে একটা চড়াই পাখি উড়াল দিল যেন।
সামনে তোক দাঁড়িয়ে।
দাঁতে-দাঁতে কত্তাল বাজছিল নয়নের। সে বাবা-গো’ বলে ফের চোখ বুজে ফেলল।
লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কে তুই?”
“আজ্ঞে আমি দলের লোক।”
“এখানে কী করছিস?”
“আজ্ঞে পাহারা দিচ্ছিলাম।”
লোকটা অবাক হয়ে বলল। “ছাদে তো আমার ডিউটি তুই এলি কোত্থেকে? হাতে দড়িই বা কেন?”
নয়ন একটু সাহস করে বলল, “যদি কাউকে ধরে ফেলি তে বাঁধতে হবে না?”
“ওঃ, তাই বল!” বলে হঠাৎ লোকটা হাসতে হাসতেই ঠাস করে একটা চড় কষাল নয়নের গালে। সেই চড়ে চোখে ফুলঝুরি দেখতে লাগল নয়ন। বাপ রে, কী চড়!
২৬-৩০. যখন একটু ধাতস্থ হল নয়নকাজল
যখন একটু ধাতস্থ হল নয়নকাজল, তখন আবার আত্মারামের খাঁচা ছাড়ার উপক্রম। লোকটা তার কণ্ঠার কাছে বল্লমের চোখা ডগাটা ধরে আছে। যা ধার, তাতে একটু চাপ দিলেই গলা এফেঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে। নয়নের বুক ঢিবঢিব করছে, মা কালীর নামটাও স্মরণে আসছে না।
লোকটা জিজ্ঞেস করল, “তোর নাম কী?”
নয়নকাজল জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, “ইয়ে মানে–”
সর্বনাশ! নয়নকাজল দেখে নিজের নামটাও তার মনে নেই মোটেই। মাথাটা এত ঘেবড়ে গেছে যে, কোনও কথা স্পষ্ট মনে পড়ছে না। বাবার নামও নয়, নিজের নামও নয়, কারো নামই নয়। তবে উপায়?
“কী রে?” বলে লোকটা বল্লমটা একটু নাড়ে। নয়নকাজল চেঁচিয়ে বলে, “আমার নাম লোক।”
“লোক?” বলে লোকটা অবাক হয়ে পড়ে থাকা নয়নকাজলের দিকে চেয়ে বলে, “লোক আবার কারো নাম হয় নাকি?”
“কে জানে বাপু। নিজের নামটা আমার মনে পড়ছে না তেমন। মেলা খোঁচাখুঁচি কোরো না, লেগে যাবে।”
“এখানে কী করিস?”
“ডাকাতি। আর কী করার আছে?”
“তুই কেমনধারা ডাকাত? আমার মতো রোগাপটকা লোকের একটা চড় সহ্য করতে পারিস না। কোন আহাম্মক তোকে দলে ভিড়িয়েছে?”
এ-কথায় নয়নের খুব অপমান বোধ হল। লোকটা তেমন রোগাপটকা মোটেই নয়। দিব্যি ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা। হাতের চড়টাও বেশ খোলতাই হয়। নয়ন বলল, “চড়-টড় খাওয়া আমার অভ্যেস নেই।”
লোকটা হাসল! বলল, “তা দড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলি? গলায় দড়ি দিতে?”
দড়ির কথায় নয়নের গোটা ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল। তাই তো। রামু যে হাঁ করে বসে আছে তার জন্য। আর তো দেরি করা যায় না।
নিজের অবস্থাটা আড়চোখে একটু দেখে নিল নয়ন। খুবই খারাপ অবস্থা। ছাদের ধুলোবালির মধ্যে চিত হয়ে পড়ে আছে সে। তার বুকের দুদিকে দুখানা পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে নোকটা! হাতের বল্লম তার গলায় ঠেকানো। নড়ার সাধ্য নেই।
নয়ন বলল, “তা গলায় দড়ি দিলেই বা কী? তোমার বল্লমের চেয়ে সেটা কতটা খারাপ হবে?”
মতলবটা কী ফেঁদেছিলি সেটা খোলসা করে বল তো বাপ। নইলে গেলি।”
নয়ন লক্ষ্য করছিল, লোকটা তাকে মানুষ বলেই তেমন গ্রাহ্য করছে। ভাবছে নয়নের পিঁপড়ের প্রাণ, তাই ততটা সাবধানও হচ্ছে না। নয়ন নিজের ডান পাটা একটু তুলল। না, লোকটা লক্ষ্য করছে না। পা তোলার ঘটনাটা ঘটছে লোকটার পিছন দিকে। সুতরাং নয়ন লোকটাকে পিছন থেকে একটা রাম লাথি কষাতে পারে। ভয় হল, সেই ধাক্কায় লোকটার বল্লম না আবার তার গলায় বিঁধে যায়। তাই লাথি মারার সঙ্গে-সঙ্গে হাতের ঝটকায় বল্লমটা সরিয়ে নিতে হবে। তারপর মা-কালী ভরসা। নয়ন লোকটাকে অন্যমনস্ক করার জন্য হঠাৎ একটু কঁকিয়ে উঠে বলল, “আমার পেটে বড় ব্যথা। বল্লমটা সরাও।”
লোকটা আবার তার নাটুকে হাসি হেসে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বলা আর হল না। নয়নের আচমকা লাথিটা লোকটাকে দুহাত ছিটকে দিল। হুড়মুড় করে লোকটা যেই পড়েছে অমনি নয়ন বল্লমটা বাগিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। খুনটুন সে জীবনে করেনি। তাই বল্লমটা লাঠির মতো বাগিয়ে ইচ্ছেমতো ঘা কতক দিল লোকটাকে। লোকটা নেতিয়ে পড়ে রইল চুপচাপ।
নয়নকাজল দড়ি নিয়ে ছাদের একটা মজবুত রেলিং-এ বেঁধে খানিকটা নিজের কোমরে জড়াল। এখন আর তার আলসে দিয়ে নামতে ভয় করছে। তার চেয়ে বড় ভয় ওই লোকটার যদি চট করে জ্ঞান ফিরে আসে।
দড়ি ধরে একটু ঝুঁকতেই রামুর ঘরের ঘুলঘুলিটা হাতের নাগালে পেয়ে গেল সে। দড়িটা নামিয়ে দিয়ে ডাকল, “রামু!”
“এই যে!”
“উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি। বাইরে বিপদ।”
রামু গোবিন্দর কাছে কায়দা-কসরত কিছু কম শেখেনি ক’দিনে। দড়ি ধরে টপ করে ঝুল খেয়ে উঠে এল ঘুলঘুলিতে। তারপর দড়িটা টেনে নিয়ে বাইরের দিকে ঝুলিয়ে নেমে আসতে খুব বেশি সময় লাগল না।