গোবিন্দ বলে, “তাহলে কী বলব? সাতনা কি আমাদের কথা বিশ্বাস করবে?”
“করবে। মেয়েটার একটা ছবি আমার কাছে। সেটা ওকে দিও। তাহলে বিশ্বাস করবে।”
.
২৫.
পরের রাতেও নয়নকাজল এল। রামু ভেবেছিল, বেত খেয়ে নয়নকাজলের বুঝি হয়ে গেছে। কে দরজায় শব্দ করল। রামু উঠে গিয়ে দরজায় মুখ লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
–”আমি নয়নদা।”
“ডঃ নয়নদা! তুমি ভাল আছ?”
“ভাল কি আর থাকি? সারা গায়ে কালশিটে, কঁকালে ব্যাথা, চলতে গেলে মাথা ঘোরে।”
“তোমাকে খুব মেরেছে নয়নদা?”
“খুব। মেরেই ফেলত। কিন্তু পাখিটার মুখ থেকে এখনো কথা বেরোয়নি বলে প্রাণটা আমার রেয়াত করেছে।”
“তুমি পালিয়ে যাচ্ছ না কেন নয়নদা? গিয়ে পুলিশে খবর দাও।”
নয়ন একটু দুঃখের হাসি হেসে বলল, “পালালে যদি বাঁচতুম রে ভাই, তবে, তবে কি আর চেষ্টা করতুম না! আর পুলিশের কথা কি বলব! আমার মতো গরিব-দুঃখী মানুষের কথায় তারা গা করবে না।”
“তাহলে উপায়?”
“উপায় কিছু দেখছি না। যদি নিতান্ত চুনোপুঁটি ভেবে যদি ছেড়ে-টেড়ে দেয়। ভগবান ভরসা। তোমার জন্য আজ আর দুধটুকু আনতে পারিনি।”
“দুধ গবে না। শোনো নয়নদা, এদের সর্দার যখন আবার আমার কাছে আসবে, তখন আমি তাকে বলে দেব যেন আর কখনো তোমার গায়ে হাত দেয়। দিলে আমি পাখির মুখ দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করব না।” নয়ন একটু অবাক হয়ে বলে, “সর্দার! সর্দারকে তুমি কোথায় দেখলে? “কেন ঐ দানবের মতো লোকটা। সাতনা না কী যেন নাম।”
নয়ন একটা শ্বাস ফেলে বলল, “সাতনা সর্দার টর্দার নয়। তবে মোড়ল গোছের একজন বটে। আসল সর্দার যে কে, তা এরা নিজেরাও ভাল জানে। যেই হোক তার অনেক ক্ষমতা। তাকে সবাই যমের মতো ডরায়।”
“তুমি সর্দারকে দেখনি?”
“আমি কেন, এরাও অনেকে দেখেনি। ওসব নিয়ে ভেবো না। সাতনাকে আমার কথা বললে হিতে বিপরীত হবে। এখন ছেড়ে রেখেছে, তুমি কিছু বললে হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে রাখবে।”
“তাহলে বলব না, কিন্তু এই যে তুমি আমার কাছে এসেছ, যদি ধরা পড়ে যাও?”
“সে ভয় খুব একটা নেই। তোমার ওপর এরা তেমন কড়া নজর রাখছে। তুমি ছোট ছেলে, দরজা ভেঙে পালাতে তো পারবে না, আর পালালেই বা যাবে কোথায়? চারদিকে জঙ্গল।”
“এখানে ওরা কজন আছে?”
“বেশি নয়। তবে সব সময়েই তোক আনাগোনা করে। বিরাট কাণ্ড। বিরাট কাণ্ড। কোদাল গাঁইতি দিয়ে চারদিকে খুব খোঁড়াখুঁড়িও হচ্ছে গুপ্তধনের জন্য।”
“কিছু পেয়েছে?”
“না, পাওয়া বড় সহজ নয়।”
“পাখিটা কোথায়?”
“সে খুব ভাল জায়গায় আছে। আমাদের নাগালের বাইরে।”
রামু উত্তেজিত গলায় বলল, “শোনো নয়নদা, আমাদের যেমন করে হোক, পালাতেই হবে। এখানে থাকলে তুমি বা আমি কেউই হয়তো বেঁচে থাকব না।”
“পালাবে? ও বাবা!”
“ভয় পাচ্ছ কেন? মরার চেয়ে তো পালানোই ভাল।”
“ ভাল কিন্তু…”
“কিন্তু টিন্তু নয়। ভাল করে দ্যাখো, এ-ঘর থেকে বেরোনোর কোনো উপায় আছে কিনা।”
“দেখেছি। নেই।”
“ছাদে উঠতে পারো?”
“তা পারি।”
“আর-একটা দড়ি লাগবে।”
“তাও জোগাড় হবে। কিন্তু অত সাহস ভাল নয়। শুনেই আমার হাত পা কঁপছে।”
“শোনো নয়নদা, না পালালেও এরা রেহাই দেবে না। আমাকে যদি নাও মারে, তোমাকে মারবে। কারণ তুমি বড় মানুষ, ওদের অনেক গোপন খবর জেনে গেছ। কাজেই তোমার না পালিয়ে উপায় নেই। যদি দুজনে পালাতে পারি, তবে আমি বাবাকে গিয়ে সব বলল। বাবা পুলিশের কাছে। গেলে পুলিশ কিছু না-করে পারবে না। তা ছাড়া গোবিন্দদা আর গবাদা আছে। ওরা ঠিক একটা বুদ্ধি বের করবে।”
নয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কিন্তু পালানোর উপায়টা কী ভেবেছ?”
“খুব সোজা। দক্ষিণ দিকে ছাদের কাছে একটা বড় ঘুলঘুলি আছে। অবশ্য অনেক উঁচুতে। ঘুলঘুলিতে পাতলা তারের জাল দেওয়া জালটা পুরনো হয়ে মচকে পড়ে পচে গেছে। তুমি ছাদে উঠে কার্নিশে ভর দিয়ে ওই ঘুলগুলির ভিতর দিয়ে দড়ি নামিয়ে দেবে। আমি দড়ি ধরে উঠে যাব।”
“পারবে? পড়ে যাবে না তো?”
“না না। আমি গোবিন্দ-মাস্টারের কাছে অনেক মিল নিয়েছি। কিন্তু তুমি খুব সাবধান।”
“আজ রাতেই পালাবে নাকি?”
“আজ, এক্ষুনি। কাল আবার কী হয় কে জানে?”
“আমার বড় ভয় করছে রামু। পুরনো কার্নিশ ভেঙে যদি পড়ে যাই?”
“কার্নিশ যদি পুরনো হয় তাহলে ছাদের রেলিং বা শক্ত কিছুতে দড়িটা বেঁধে নিজে কোমরে জড়িয়ে নিও। পড়বে না কিন্তু সাবধান। শব্দটব্দ কোরো না।”
“আচ্ছা। কিন্তু পারবে তো রামু?”
“আমি পারব। তোমাকেও পারতে হবে।”
“দেখি তাহলে।” মিনমিন করে এ কথা বলে চলে গেল নয়ন।
রামু শীত তাড়ানোর জন্য কয়েকটা ডন-বৈঠক করল। স্কিপিং-এর ভঙ্গিতে নেচে মাংসপেশীর আড় ভেঙে নিল। গা গরম করে না নিলে হঠাৎ কঠিন পরিশ্রম করতে গিয়ে পেশীতে টান ধরে যায়। গোবিন্দদা তাকে অনেক কটা কসরত শিখিয়েছে। সবই ফ্লোর একসাইজ। তার কয়েকটা করে নিল রামু।
তারপর কম্বল মুড়ি দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অন্ধকার ঘরে ঘুলঘুলিটা খুব আবছা দেখা যায়। অনেকটা উঁচুতে। খুব বড় ঘুলঘুলি নয় বটে, তবে রামু গলে যেতে পারবে। কিন্তু কথা হল, নয়নকাজল পারবে কি না কার্নিশে নামতে। একে ভীতু মানুষ, তার ওপর নয়ন তো আর খেলাধুলো করে না।
ওদিকে নয়ন পড়েছে মুশকিলে। একতলার একটা ঘরে মেলা দড়িদড়া শাবল খন্তা মজুত থাকে। দরজায় তালা-ও নেই। সে নিঃশব্দে গিয়ে একটা দড়ি বের করে এনেছে বটে, কিন্তু বাকি কাজ করতে ডরে ভয়ে হাত-পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে।