যুধিষ্ঠির ভ্রুকুটিকুটিল মুখে বসে রইলেন চুপচাপ। হঠাৎ কুঁজোয় জল নিয়ে বাড়ির চাকরটা ঘরে ঢুকল। যুধিষ্ঠির আনমনে তার দিকে তাকালেন। তারপর হঠাৎ অন্যমনস্কতা ঝেড়ে ফেলে ভাল করে তীক্ষ্ণ নজরে দেখলেন
লোকটাকে, খুব লম্বা নয়, মজবুত গড়ন, গালে কিছু দাড়ি। তবু তাঁর স্মৃতি চমকে উঠল। যুধিষ্ঠির সোজা হয়ে বসলেন। উদ্বববাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “এ বুঝি আপনাদের নতুন কাজের লোক?”
“হ্যাঁ। এই তো তিন দিন হল কাজে লেগেছে।”
যুধিষ্ঠির আর কিছু বললেন না। তবে চাকরটা চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ দরজার দিকে চেয়ে রইলেন, হুঁ।”
উদ্ধববাবু যুধিষ্ঠিরের মুখের দিকে চেয়ে ছিলেন। লোকটা কেমন তা বুঝতে পারছিলেন না। তবে গোপনে শ্রীধরবাবুর কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন। শ্রীধরবাবুর ভাঙা পা এখনো সারেনি। তিনি অবশ্য ভরসা দিয়ে বলেছে, যুধিষ্ঠির সম্পর্কে চিন্তা করবেন না। অতি উত্তম ছেলে। আমি বহুকাল ধরে চিনি।
উদ্বববাবু অবশ্য নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। আজকাল তার সকলেকেই সন্দেহ হয়। তিনি যুধিষ্ঠিরের মুখের ভাবসাব দেখে সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ওকে চেনেন নাকি?”
যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বললেন, “না বোধ হয়। চেনা-চেনা লাগছিল বটে, তবে কত মানুষের সঙ্গে কত মানুষের চেহারার মিল থাকে।”
এই বলে যুধিষ্ঠির উঠলেন। বললেন, “রামুর ব্যাপারে আমার যদি কিছু করার থাকে তবে আমাকে বলবেন। শত হলেও সে আমার ছাত্র। বলতে কী আমার অমন উজ্জ্বল বুদ্ধিমান ছেলে কমই দেখেছি।”
“বলেন কী?”
উদ্ধববাবু অবাক হয়ে বলেন, “রামু উজ্জ্বল বুদ্ধিমান?”
“ঠিক তাই। দুষ্টুমির স্টেজটা কেটে গেলেই সেটা বোঝা যাবে।”
উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
যুধিষ্ঠিরবাবু সন্তর্পণে বেরিয়ে এলেন। উঠোনের দিকটায় চাকরটা ভেজা কাপড়জামা মেলছে রোদ্দুরে, যুধিষ্টির চাপা স্বরে ডাকলেন, “ওহে, ও গোবিন্দ মাস্টার।”
গোবিন্দ চমকে চিতাবাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল। চোখ ধকধক করে জ্বলছে।
যুধিষ্ঠির একটু হাসলেন। তারপর কাছে গিয়ে বললেন, “ভয় পেও না। একটু বাইরে নিরিবিলিতে চলো। তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।”
গোবিন্দর চোখের আগুনটা নিভে গেল। বলল, “আজ্ঞে।”
যুধিষ্ঠির গোবিন্দকে নিয়ে বাইরে এলেন। নিরিবিলি বকুলগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “আমাকে চিনতে পারো?”
গোবন্দ মুখোনা ভাল করে দেখল। তারপর চাপা স্বরে বলল, “চিনি। হরিহর পাড়ুইয়ের ছেলে না তুমি?”
যুধিষ্ঠির মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন, “ধরেছ ঠিক। আমার বাবা বড় ভাল লোক ছিল না। পদবীটা আজকাল আর ব্যবহার করি না? এখন আমি যুধিষ্ঠির রায়।”
গোবিন্দ কঠিন স্বরে বলল, “কী চাও? বাপের খুনীকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে?”
যুধিষ্ঠির গম্ভীর হয়ে বললেন, “না। আমার বাবা যেসব পাপ করেছিলেন তাতে তাঁর খুন হওয়া কিছু বিচিত্র ছিল না। তার খুনীর ব্যবস্থা সরকার করবে। আমার তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমি জানতে চাই তুমি কোন দলে? কেনই বা এ-বাড়িতে চাকর সেজে আছ?”
গোবিন্দ খুব তীব্র দৃষ্টিতে যুধিষ্ঠিরকে দেখছিল। হরিহরের ছেলে লেখাপড়া শিখেছে বলে জানে। হরিহরও বলত তার ছেলে নাকি তার মতো নয়। গোবিন্দ একটা শ্বাস ফেলে বলল, “তোমার হয়তো বিশ্বাস হবে না, হরিহরকে আমি খুন করিনি।”
“হতে পারে। এখন আসল কথা বলো। তুমি এখানে কী করছ? চাকর সেজে থাকলেই তো ১লবে না। যদি বুঝি তোমার মতলব খারাপ তাহলে উদ্ধববাবুকে তোমার আসল পরিচয়টা আমাকেই দিতে হবে।”
গোবিন্দ একটু হেসে বলল, “উনি জানেন। আমি রামুর দলে। সাতনার দলে নেই।”
যুধিষ্ঠির একটু অবাক হয়ে বললেন, “সাতনা? সে আবার এর মধ্যে আছে নাকি?”
“আছে। দলের সর্দার না হলেও সে বেশ পাণ্ডা গোছের লোক। আমার ধার হরিহরকে সে-ই খুন করেছিল।”
যুধিষ্ঠির একটু আনমনা হয়ে যান। অনেকক্ষণ দূরের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলেন, “সাতনা!”
“সাতনাকে আমিও চিনতাম। সে লোক খারাপ ছিল না।”
যুধিষ্ঠির ব্যথিত মুখে মাথা নেড়ে বলেন, “তার মেয়েটা চুরি যাওয়ার পর থেকেই সে মানুষ থেকে জানোয়ার হয়ে গেল। তা শোনো গোবিন্দ মাস্টার, যদি সাতনার দলই রামুকে চুরি করে থাকে তাহলে একটা উপায় হয়তো করা যাবে।”
“তার মানে?”
যুধিষ্ঠির ব্যথিত মুখে বললেন, “সাতনার মেয়েটাকে চুরি করেছিলেন আমার বাবাই। গবার কী মতলব ছিল জানি না। হয়তো সাতনার কাছ থেকে কিছু আদায় করা। কিন্তু চুরি করলেও মেয়েটাকে বাবা মেরে ফেলেননি। আমার এক নিঃসন্তান মাসির কাছে রেখে এসেছিলেন। যতদূর জানি মেয়েটা এখনো সেখানেই আছে। যত্নে আছে। সাতনাকে বহুবার খবরটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। পারিনি।”
“বলো কী!” গোবিন্দর চোখ কপালে উঠল।
“ঠিকই বলছি। তুমি যদি খবরটা সাতনার কাছে পৌঁছে দিতে পারো তাহলে হয়তো কাজ হবে। বলবে রামুকে ফেরত দিলে সে তার মেয়েকে ফেরত পাবে।”
উত্তেজিত গোবিন্দ কঁপতে কাঁপতে বলল, তোমার মাসির ঠিকানাটা?”
যুধিষ্ঠির মৃদু হেসে বললেন, “ওটা এখন গোপন থাক। তবে নিশ্চিন্ত থাকো, মেয়েটা আছে। আগে খবরটা সাতনার কানে পৌঁছে দাও। তারপর যা করার আমিই করব।”
“তোমার কথা কি সাতনাকে বলব?”
“না বলাই ভাল।” যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে বলেন, “কারণ যে-গুপ্তধনের জন্য তোমরা সবাই হন্যে হয়ে গেছ তার আসল উত্তরাধিকারী আমিই। কিন্তু আমি ওসব দাবি করব না। আমি চাই গুপ্তধনের উদ্ধার হলে তা সরকারের তহবিলে জমা হোক। সাতনা জানে যে আমিই ওই গুপ্তধনের ওয়ারিশ। কাজেই আমি বেঁচে আছি জানলে সে আমাকে খুন করতে চাইবে।”