“কিন্তু তোমাকে খুন করবে কেন?”
“সেইই তো হয়েছে মুশকিল। একবার এদের দলে ভিড়লে তার আর ছাড়ান-কাটান নেই। তাকে আর এরা কিছুতেই ফিরে যেতে দেয় না। সে ছিল একরকম। কিন্তু ওদিকে আমাকে ডাকাত বলেও স্বীকার করছে না। কোনো বখরা দেবে না, মাইনে দেবে না, চাকরের মতো খাটাচ্ছে।”
“তা তুমি এখন কী করতে চাও?”
নয়নকাজল করুণ স্বরে বলল, “এ আমারই পাপের প্রায়শ্চিত্ত রে ভাই। তাই ভাবছি আমার যা গতি হওয়ার হবে। খামোকা তুমি কষ্ট পাবে কেন? ঠিক করেছি, তোমাকে সুযোগ পেলেই পালানোর পথ করে দেব।”
“পারবে?”
“চেষ্টা তো করব। মুশকিল হয়েছে পাখিটাকে নিয়ে।”
“কী মুশকিল?”
“পাখিটা আসল কথা বলতে চাইছে না। সাতনা তোমাকে বলেছে, পাখিটার পেট থেকে কথা বের করতে না পারলে মেরে ফেলবে। আমি জানি, তুমি ত পারবে না। আর সাতনা সত্যিই তোমাকে খুন করবে।”
“ঐ বিশাল চেহারার লোকটার নাম কি সাতনা?”
“হ্যাঁ। ওর দয়ামায়া বলতে কিছু নেই।”
“ও কি দলের সর্দার?”
“আরে না। দলের সর্দার কে, তা আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। মক্ত দল, চারদিকে অনেক ডালপালা ছড়ানো।”
“আমার বাবাকে একটা খবর দিতে পারো না নয়নদা?”
“খবর দেওয়ার দরকার নেই। খবর পেলে তোমার বাবা তোমাকে উদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করবেন। তাতে তোমার বিপদ বাড়বে।”
“অন্তত গবাদাকে যদি একটা খবর দিতে পারো।”
“গবা পাগল! সে খবর পেয়ে গেছে। একটু আগে জঙ্গলে একটা লোক গান গাইছিল শুনলে না?”
“না তো!”
“আমি শুনেছি। গবারই গলা। তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না। শুধু মনে রেখো, আমি আছি। মরলে মরব, কিন্তু ধড়ে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ তোমার ক্ষতি হতে দেব না। গেলাসটা দাও, এবার যাই।”
গোলাস নিয়ে নয়নকাজল নিঃশব্দে চলে গেল।
দুধটা খাওয়ার পর শীত একটু কম লাগতে লাগল রামুর। কুটকুটে কম্বল মুড়ি দিয়ে ভরা পেটে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালবেলায় দরজা খুলে প্রথম যে ঘরে ঢুকল সে সাতনা।
ক্ষুরধার চোখে রামুর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে সে বলল, “কাল রাতে গবা পাগলা এখানে হানা দিয়েছিল, কে তাকে এ-জায়গার হদিস দিল জানো?
“আমি কী করে জানব? রামু অবাক হয়ে বলে।”
“তোমাদের চাকর নয়নকাজলকে কঁটাওলা বেত দিয়ে মার দেওয়া হচ্ছে। এখন। আমাদের মনে হচ্ছে, হদিসটা সে-ই দিয়ে এসেছে।”
রামু একটু কেঁপে উঠল ভয়ে। বলল, “নয়নদা? নয়নদা কী করে খবর দেবে? সেও তো তোমাদের দলে!”
“আমাদের দলে কিনা তা এখনো আমরা জানি না। তোমার বাবার উঁকিলের বুদ্ধি তো কম নয়। হয়তো ওকে চর করে, আমাদের দলে ভিড়িয়েছে। যাকগে, সে-সব ভেবে লাভ হবে না। এখন একটা কথা বলোতো!”
“কী কথা?”
“গোবিন্দ কোথায়?”
“কে গোবিন্দ?”
“গোবিন্দকে তুমি ভালই চেনো সারকাসের গোবিন্দ মাস্টার।”
“সে কোথায়, তা আমি কী করে জানব?”
“আমাদের সন্দেহ, গোবিন্দ তোমাদের বাড়িতে লুকিয়ে আছে। তাকে অন্য কোথাও আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।”
রামু কঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তাকে, তোমরা খুঁজছ কেন?”
“তার মুণ্ডুটা ধড় থেকে আলাদা করা দরকার। তাই খুঁজছি।”
“তুমি এরকম নিষ্ঠুর লোক কেন?
সাতনা কটমট করে রামুর দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু তারপর হঠাৎ যেন কেমন ছাইমারা হয়ে গেল তার মুখ। যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দরজাটা আঁট করে বন্ধ করে দিল পাহারাদার।
.
২৪.
যুধিষ্ঠিরবাবুর কামাই নেই, রোজ যেমন আসেন তেমনই আজও পড়াতে এসেছেন। কিন্তু যাদের পড়াচ্ছেন তাদের পড়ায় মন নেই। রামুর দুই
দাদা আর তিন দিদির মুখ ভার, চোখ ছলছল গোঁজ হয়ে তারা বসে থাকে।
যুধিষ্ঠিরবাবু আজ বইপত্র খুললেন না, টাস্কও দেখলেন না। রামুর সবচেয়ে বড় দাদা সোমনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, “রামুর কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি, না?”
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, “না আমাদের মা জল পর্যন্ত মুখে তুলছে।, বাবার চেহারা অর্ধেক হয়ে গেছে।”
যুধিষ্ঠিরবাবু গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে বললেন, “, তা তোমার বাবার সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে?”
“হ্যাঁ। বাবা তো ঘরেই শুয়ে আছেন।”
“আমাকে একটু তাঁর কাছে নিয়ে চলো তো!
উদ্ধববাবু আর একটা বিনিদ্র রাত কাটিয়ে সকালে উঠেছেন। যন্ত্রের মতো পূজো-আচ্চা সেরে এসে ঘরে শুয়ে পড়েছেন। বুকটা বড় কঁপে আজকাল। মাথায় কত যে চিন্তা!
যুধিষ্ঠিরবাবুকে নিয়ে সোমনাথ ঘরে ঢোকার পর তিনি আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “বসুন যুধিষ্ঠিরবাবু।”
যুধিষ্ঠির বসে বললেন, “রামুর খবরটা আমি বাইরের লোকের মুখে শুনেছি।”
উদ্ধববাবু কাতর স্বরে বললেন, “হ্যাঁ, বড় পাঁচকান হয়ে গেছে। এখন ভয়, খবরটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার ওরা আমার ছেলেটাকে মেরে-টেরে ফেলে।”
যুধিষ্ঠির গম্ভীর হয়ে বললেন, “আপনি পুলিশকে কি সবকথা জানিয়েছেন?”
উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “হ্যাঁ কুন্দকুসুম সবই জানে, বিচক্ষণ লোক। কিন্তু সেও তো কিছু করতে পারল না।”
যুধিষ্ঠির একটু হেসে বললেন, “আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন উদ্ধববাবু, সবাই সবকিছু জানে। কিন্তু কাজের বেলা কেউই কিছু করতে পারছে না।”
উদ্ধববাবু বুক কাঁপিয়ে আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “করা হয়তো যেত কিন্তু রামুখে আটকে রেখে ওরা আমাদের একেবারে জব্দ করে দিয়েছে। কাল রাতে এসে কুন্দকুসুম বলে গেল কিছু করা সম্ভব নয়। তাহলেই ছেলেটার বিপদ। এই অবস্থায় আমারও মাথায় কিছু খেলছে না।”