রামু ভয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। অতি কষ্টে বলল, “গবাদা তো পাগল।”
“ওর পাগলামিটা চালাকি ছাড়া কিছুই নয়। সেটা আমরা জানি। কিন্তু ওর আসল পরিচয়টা আমাদের দরকার।”
“গবাদা কারো কোন ক্ষতি করে না তো।”
“ক্ষতি যাতে করতে না পারে তার জন্য সাবধান হওয়া ভাল।”
“গবাদার আর কোনো পরিচয় আমি জানি না।”
লোকটা অবশ্য রামুকে এ নিয়ে আর খোঁচাখুঁচি করেনি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বাদে আবার লোকটা এল। কিন্তু তার সঙ্গে নয়নকাজলকে দেখে রামু হাঁ। সে চেঁচিয়ে উঠল, “নয়নদা।” কিন্তু সঙ্গের লোকটা রামুকে একটি ধমক মেরে বলল, “চাপ!” রামু ভয়ে চুপ করে গেল! নয়নকাজলও রামুর দিকে ভাল করে চাইতে পারছিল না। অন্য দিকে চেয়ে রইল। তার হাতে রামুদের কাকাতুয়ার দাঁড়টা।
দৈত্য লোকটা বলল, “এই পাখিটা কিছু গোপন খবর জানে। কিন্তু কিছুতেই বলছে না। তোমাদের পোষা পাখি, তোমরা নিশ্চয়ই এর গোপন কথা জানো!”
রামু মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। পাখিটা গুপ্তধনের কথা বলে বটে, কিন্তু কোথায় তা আছে তা কখনো বলেনি।”
লোকটা বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু তোমার কাজ হল পাখিটার পেট থেকে কথা বের করা। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। যদি তার মধ্যে পারো ভাল,
যদি না পারো তবে পাঁচ ঘা করে বেত খাবে রোজ। এই নয়নকাজলও থাকবে পাশের ঘরে। সে নজর রাখবে তুমি কী করছ না-করছ।”
রামু আর নিজেকে সামলাতে না-পেরে জোরে চেঁচিয়ে উঠল, “নয়নদা! তুমিও এদের দলে?”
নয়নকাজল তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
২৩.
ঘুম বারবার ভাঙছে রামুর। বড় শী; বিছানাটাও বড় শক্ত, তেইশ।
কম্বল কুটকুট করছে। জেগে উঠলে সে জঙ্গলের গভীর নিস্তব্ধতা টের পায় আর গা ছমছম করে ওঠে তার। যে-বাড়িটায় তাকে আটকে রাখা হয়েছে, সেটা বিশাল। তবে প্রায় সবটাই ভেঙে পড়ে গেছে। এখানে-সেখানে এক-আধটা ঘর দাঁড়িয়ে আছে কোনক্রমে। বাদবাকিটা হঁট আর চুন-সুরকির ভূপ। ডাকাতরা যথাসম্ভব বাড়িটাকে নিজেদের থাকার মতো করে নিয়েছে। তবে রামু জানে এটা ওদের স্থায়ী আড়ডা নয়। একসঙ্গে বেশি লোক এখানে থাকে না। প্রায় সব সময়েই আনাগোনা করে। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সে-দরজাও পেল্লায় ভারী কাঠের। ঘরখানাও খুবই বড়-সড়। মেঝেয় আর দেওয়ালে পঙ্কের কাজ করা। তবে সবই অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। মেঝেয় ফাটল, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দিনের বেলা ঘরটা খুব ভাল করে দেখে নিয়েছে রামু। পালানোর কোন পথ নেই। আর পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? চারদিকে জঙ্গল। ডাকাতরা চারদিকে নজর রাখছে। ঘুম ভেঙে অন্ধকারে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল রামু। শীতে একটু থরথরানি উঠছে শরীরে। কম্বলটা ভাল করে মুড়ি দিয়েও শীত যাচ্ছে না।
হঠাৎ দরজায় একটু শব্দ হল। খুব মৃদু টোকা দেওয়ার মতো শব্দ। রামু কান খাড়া করল। না, ভুল নয়। আবার গোটা দুটি টোকা পড়ল।
স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই রামু বুঝল, এই টোকা ডাকাতদের নয়। অন্য কারও কোনো কাণ্ড। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। কম্বল মুড়ি দিয়ে দরজার কাছটায় এসে হাঁটু গেড়ে বসে রইল সে চুপচাপ। খানিকক্ষণ বাদে একটু জোরে টোকা দেওয়ার শব্দ। কে যেন চাপা গলায় ডাকল, “রাম!”
গলাটা চিনল রামু। বিশ্বাসঘাতক নয়নদা। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হলেও এই শত্ৰুপুরীতে নয়নকাজলই তার একমাত্র চেনা লোক। এমনিতে একসময়ে নয়নদা রামুকে ভালও বাসত খুব। পেয়ারার ডাল দিয়ে গুলতি বানিয়ে দিয়েছে, চাবি পটকা বানাতে শিখিয়েছে, তার টাইফয়েডের সময় এই নয়নকাজলই লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে সন্দেশ এনে খাইয়েছে।
রামু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার কাছে মুখ নিয়ে বলল, “কে, নয়নদা?”
“হ্যাঁ। পাহারাদারটা একটু তফাতে গেছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ফাঁকে এলাম।”
“কী চাও?”
“শোনো, এই দরজায় বাঁ দিকের পাল্লায় একটা ফোকর আছে। এমনিতে বোঝা যায় না। হাতড়ে-হাতড়ে খুঁজলে একটা ছোট্ট আলপিনের ডগার মতো জিনিস পাবে। সেটা টানলেই গোলমতো একটা ঢাকনা খোলা যায়।”
“তা দিয়ে বেরোতে পারব?”
“না। বেরোনোর কথা এখন ভেবো না। এরা অত কঁচা ছেলে নয়।”
“তাহলে ফোকর দিয়ে কী হবে?”
“তোমার জন্য এক গেলাস দুধ এনেছি।”
“তুমি তো জানোই দুধ খেতে আমার ভাল লাগে না।”
“সে জানি। কিন্তু এদের দেওয়া খাবার যে তোমার মুখে রুচছে না, তাও তো দেখছি। এরকম আধপেটা খেয়ে থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে যে। আর ও ট্যালটেলে দুধ নয়। একদম ক্ষীরকরা দুধ, সরে ভর্তি।”
রামু দরজা হাতড়ে ফোকরটা খুলতে পারল। নয়নদার দেওয়া দুধটা হাত বাড়িয়ে নিল। মুখে দিয়ে দেখল সত্যিই চমৎকার ক্ষীরের গন্ধ। পুরু সর।
“কী, ভাল?”
“ভাল কিন্তু তুমি তো এদের দলে। তবে আমার জন্য ভাবছ কেন?”
নয়নকাজল একটু চুপ করে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কপালের ফের রে ভাই। লোভে পড়ে এদের দলে ভিড়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি প্রাণসংশয়।”
“তার মানে?”
“মানে এরা আমাকে এক বিন্দু বিশ্বাস করে না। তোমার মতো আমাকে ঘরে আটকে রাখেনি বটে, কিন্তু এদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোরও উপায় নেই। সব গাঁয়ে-গঞ্জে এদের লোক আছে। যেখানে যাব, সেখানেই গিয়ে খুন করে আসবে।”
রামু বলল, “এরা কি মাফিয়াদের মতো?”
“কে জানে বাপু কাঁদের মতো। তবে বিরাট দল। শুনেছি জেলখানাতেও নাকি এদের চর আছে। এদের কোনো লোককে পুলিশ ধরলে সে তিনদিনের মধ্যে জেল ভেঙে পালিয়ে আসে।”