গবা হাতটা টেনে ধরে বলল, “দূর পাগল। অতটা বেপরোয়া হোসনে। বিপদ ঘটতে কতক্ষণ?”
“তুমি গানটা তাহলে আর একবার ধরো! ওরা জবাব দেয় কিনা।”
গবা গলা খাকারি দিয়ে গান ধরল, “দানাপানি খায় রে পক্ষী, উড়াল দিতে চায়। তার শিকল করে ঠিনিন বেন্ধে রাখা দায়। এইবার উড়িলে পক্ষী আর না পাবে তারে। ধনরত্নের হদিস রবে চির অন্ধকারে। তাই শুন শুন বুদ্ধিমন্ত যতেক ভক্তজন। পাখিরে কওয়াতে কথা এসেছেন দুজন। অতি শিষ্ট ভদ্র নখদন্ত নাই। দুধুভাতু খাই মোরা ধর্মেরে ডরাই।”
“গবাদা।” এবার বেশ একটু হেঁকেই ডাকল গোবিন্দ।
“বলে ফ্যাল।”
“কই, কারো তো টিকি দেখছি না।”
“এখনো বোধহয় মাপজোখ করছে।”
“দাঁড়াও। ওদিকে এক বাঁশঝাড়ের কাছে একটা ছায়া মতো দেখছি। বলে উঠে দাঁড়াল।
সঙ্গে-সঙ্গে বাতাসে একটা মৃদু শিসের মত শব্দ হল। অন্ধকারেও ঝিকিয়ে উঠল একটা বিদ্যগতি বল্লম।
“বাপ রে!” বলে গোবিন্দ বসে পড়ল।
বল্লমটা খচ করে বসে গেল পিছনের একটা গাছে।
“জোর বেঁচে গেছিস।” গবা গোবিন্দকে কাটাঝোঁপ থেকে টেনে তুলতে তুলতে বলে।
“অন্ধকারেও নিশানা দেখেছ? এই টিপ যার-তার হাতের নয়।”
“বকবক করিসনি। এখন চল, উঠে লম্বা দিই।”
গোবিন্দও কথাটায় সায় দিয়ে বলল, “তাই চলো। কিন্তু ওরা আমাদের বিশ্বাস করল না কেন বলো তো?”
“সেটাই বুদ্ধির কাজ।”
দুজনে জঙ্গলের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে আসতে থাকে।
জঙ্গলের বাইরে এসে গবা একটু হাঁপ ছেড়ে বলে “আর যাহোক, হোক, আমাদের গান ওদের কানে তো পৌঁছেছে। যদি কাজ হয় তো ওতেই হবে।”
“আমরা কারা তা জানবে কী করে?”
“খোঁজ নেবে। জানা কিছু শক্ত না। একটু বুদ্ধি চাই। সেটা ওদের ভালই আছে।”
বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে গোবিন্দ জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু সাতনার দল আমাকে খড়ের গাদায় পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল কেন বলো তো!”
“সে আর বলা শক্ত কী? তোকে মারলে হরিহরের সত্যিকারের খুনি বেঁচে যাবে। তুই যে নির্দোষ তা আর প্রমাণ হবে না।”
“আমাকে হাতে পেলে কি ওরা মেরে ফেলবে গবাদা?”
“চেষ্টা তো করবেই।” গোবিন্দ আর কিছু বলল না।
গবা বলল, “রামুটার কথা ভাবছি। কীভাবে রেখেছে ওকে কে জানে! উদ্ধববাবুকে শাসিয়ে গেছে, পাখিচুরির কথা পাঁচকান হলে রামুকে জ্যান্ত রাখবে না। তা সে-কথা তো দুনিয়া-সুষ্ঠু লোক জেনে গেছে।
এ-কথায় গোবিন্দ থমকে দাঁড়িয়ে গবার হাত চেপে ধরে বলল, “গবাদা, ফিরে যাই চলে। আমরা দুজন হলেও দশজনের মহড়া নিতে পারি। চলো গিয়ে ওদের ডেরা হুটোপাট করে দিয়ে রামুকে নিয়ে আসি।
গবা মাথা নেড়ে একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “উদ্ধববাবু রামুকে খুব শাসন করে বটে, কিন্তু আমি জানি, ওই দুষ্টু ছেলেটাই ওঁর সবচেয়ে প্রিয়পুত্র। যদি কোন খারাপ খবর পান তাহলে আর বাঁচবেন না।”
“তাহলে?”
“তাহলেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা চাই। সব কাজেই যে বুক চিতিয়ে বোকা-সাহস দেখাতে হবে তার কোন মানে নেই। উঁচ হয়ে ঢুকবি, বোমা হয়ে বেরোবি।”
“ঢুকতে দিচ্ছে কোথায়! যা একখানা বল্লম ঝেড়েছিল আজ।”
“রোস না দুদিন। পাখির মুখ থেকে তো আর আসল কথাটি বেরোচ্ছে!”
কাশিমের চর নিঃঝুম। হাড় কাঁপানো শীতে কুয়াশায় কম্বল জড়িয়ে গোটা জায়গাটাই ঘুমিয়ে আছে যেন। মাঝে-মাঝে শেয়ালের ডাক আর পাছার ভুতুড়ে শব্দ ওঠে ঝোপেঝাড়ে। রাতপাখি ডেকে ওঠে হঠাৎ-হঠাৎ। বাঁশবনে ঝিঝির ঝিনঝিন। কিন্তু এইসব শব্দ যেন কাশিমের চরের নির্জনতাকেই আরো গাড় করে তোলে।
দোতলার একটা ছোট্ট কুঠুরির মধ্যে মেঝের ওপর চটের বিছানায় রামু শুয়ে আছে। গায়ে একটা কুটকুটে কম্বল, এরকম শুয়ে তার অভ্যাস নেই। মেঝে থেকে চট ভেদ করে পাথুরে ঠাণ্ডা আসছে। কুটকুটে কম্বল দিয়ে ঢুকছে বাইরের শীত। বারবার তাই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে রামুর। দুষ্টুমি করতে গিয়ে বহুবার বহুরকম বিপদে পড়েছে। দুষ্টু ছেলেরা পড়েই। কিন্তু এরকম বিপদে সে কোনো কালে পড়েনি।
ডাকাতদের এই দলটা বেশ বড়সড়। চেহারাগুলো একদম ভদ্রলোকের মতো নয়। হাতে সবসময়ে লাঠি, বল্লম, টাঙ্গি, বন্দুক-টকও আছে। কারো কোনো মায়া দয়া নেই। খেলার মাঠ থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ এসে খবর দিল, “তোমার বাবাকে কারা যেন পূর্বলির মাঠে মারধোর করে ফেলে রেখে গেছে। শিগগির এসো।”
খবরটা পেয়েই রামু লোকটার পিছু-পিছু ছুটল। কদিন আগেই উদ্ধববাবুকে আদালত থেকে ফেরার পথে কারা বোমা মেরেছিল। এই সেদিনও বাড়িতে
ডাকাত পড়েছে। সুতরাং লোকটার কথায় রামুর অবিশ্বাস হয়নি। উদ্ধববাবুকে ওরা মারতেও পারে।
পূর্বস্থলির মাঠ শহরের বাইরে। ভারী নির্জন জায়গা। সাঁঝের আবছায়া ঘন হয়ে উঠেছে। রামু সেখানে পৌঁছে এদিক-ওদিক তাকানোরও সময় পেল না। শিমুল গাছের পেছন থেকে জনাচারেক লোক বেরিয়ে এসে একটা গামছায় তার মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর একটা গোরুর গাড়িতে তুলে ফেলল চটপট। অনেক রাতে তারা এসে পৌঁছায় এই জায়গায়। রামু পরে তাদের কথাবার্তা থেকে জানতে পেরেছে এই জায়গারই নাম কাশিমের চর।
প্রথম রাত্রিটা সারাক্ষণ বাড়ির কথা ভেবে কেঁদেছে রামু। এরা রুটি আর একটা আলুর ঝোল খেতে দিয়েছিল। তা ছোঁয়নি সে। কিন্তু সকাল থেকে রামুর চোখের জল শুকিয়ে গেল। একটা দৈত্যের মতো লম্বা-চওড়া লোক এসে তাকে প্রথমেই বলল, “শোনো রামু, তোমার এই দশা। উদ্ধব-উকিল। বোকাও বটে, জেদিও বটে। কিন্তু সে জানে না, আমার সঙ্গে বিবাদ করলে তাকে নির্বংশ হতে হবে। সে-কাজ শুরু হবে তোমাকে দিয়েই। একটু যদি বেচাল দেখি তবে রামদা দিয়ে দুখানা করে কেটে ফেলব। এখন যা জিজ্ঞেস করছি তার ঠিকঠাক জবাব দাও। প্রথমে বলল, গবা পাগলা আসলে কে!”