নতুন লোকটা মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে তা আর বলতে। তবে কিনা আমি লোক খারাপ নই।”
“তা কে জানে বাপু। আমার আর কাউকে বিশ্বাস হয় না। তবু তুমি যখন বলছ তখন একটু নির্ভর করেই দেখি।”
“আমি বলি কি বাবু, আপনি বরং শুয়ে শুয়ে দরবারি কানাড়ার সুরটা গুনগুন করতে থাকুন। ঘুমের সবচেয়ে বড় ওষুধ হল গান।”
উদ্ধববাবু কটমট করে লোকটার দিকে চাইলেন। ভাল করে দেখে তার মনে হল লোকটা ঠাট্টা করছে না। তখন খুশি হয়ে বললেন, “আমার গানের কথা তোমায় কে বলল?”
“কেউ বলেনি। ভাল গাইয়ের গলা কথাবার্তায়ও ফুটে ওঠে। কালে খাঁ সাহেব যখন চাকরকে বকতেন বা রান্নার নিন্দে করতেন, তখনো সমঝদার লোক ‘কেয়াবাত, কেয়াবাত’ করে উঠত। তাছাড়া বড় গাইয়ের বাড়ির গোরু কুকুর কি পোষা পাখির গলায় পর্যন্ত সুর এসে যায়। আপনার নেড়ি কুকুরটার গলায় আজ সন্ধেবেলাতেই আমি একটা সাপটা শুনেছি।”
“বলো কী?” উদ্ধববাবু খুবই অবাক ও উত্তেজিত হল।
লোকটা বিনয়ে হেসে হাত কচলে বলল, “সুর এমনই জিনিস যে, চেপে রাখা যায় না। যার গলায় সুর আছে, সে শত চেষ্টা করেও কোনোদিন বেসুর বের করতে পারবে না গলা থেকে। আপনার যেমন, একটু আগে শুয়ে শুয়ে ‘আঃ উঃ করছিলেন, আমি দরজার বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। শুনলাম তার মধ্যেও সুর আছে।”
উদ্ধববাবু এত দুঃখেও হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন, “সমঝদারই নেই হে দেশে, সমঝদার থাকলে কি আজ আমাকে ওকালতি করে খেতে হত? তা তুমি আমার বাড়িতেই থেকে যাও। সারকাসের সমান মাইনে দেব। কাজকর্ম কিছুই করতে হবে না। শুধু আমার একটু সেবা-টেবা করবে আর কি।”
“সে হবে’খন বাবু। এখন আমি বিদেয় হই। অনেক কাজ বাকি।”
উদ্ধববাবু শুয়ে পড়লেন। সিলিং-এর দিকে চেয়ে খুব সাবধানে গলা ঝেড়ে নিয়ে আবার উঠে বসলেন। বাঁ হাতে কান চেপে ধরে নিখুত দরবারির সুর ধরলেন। তারপর আর বাইরের শোক-দুঃখ তাকে স্পর্শ করল না।
নতুন চাকরটা নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর মৃদু একটা শিস দিল সে। অন্ধকারে আর একটা মূর্তি এগিয়ে এল কাছে। তার দুহাতে ধরা দুটো সাইকেল। দুজনে সাইকেলে চেপে এত জোরে ছুটতে লাগল যে, মোটরগাড়িও পাল্লা দিতে পারবে না।
প্রায় ত্রিশ মাইল রাস্তা একনাগাড়ের সাইকেল চালিয়ে দুজনে যখন কাশিমের চরের কাছাকাছি পৌঁছল তখন এই দুর্দান্ত শীতের রাতেও তারা ঘেমে নেয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই। সামনেই একটা জঙ্গল। মরা নদীর খাত। তারপর আবার জঙ্গল।
ঘন ঝোঁপঝাড়ে মধ্যে সাইকেল লুকিয়ে রেখে দুজনে এবার পায়ে হেঁটে চলতে লাগল। দুজনের মধ্যেই চমৎকার বোঝাঁপড়া। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না, কিছু জিজ্ঞেস করছে না। যেন আগে থেকে প্ল্যান করা আছে এই অভিযান।
দ্বিতীয় জঙ্গলটায় খানিকদূর ঢুকে দুজনে থামল। জিরোতে নয়। অন্ধকার কুয়াশামাখা এই রাতে চারদিকে কিছুই দেখা যায় না। দুজনে তাই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রাতের শব্দগুলিকে চিনবার চেষ্টা করল। কোন্ শব্দটা প্রাকৃতিক, কোষ্টা নয়। সন্দেহজনক কিছুই অবশ্য শুনতে পেল না তারা। তবে এরপর সাবধানে এগোতে লাগল।
সামনেই একটা দুর্গের মতো মস্ত বাড়ির কালো ভুতুড়ে আকারটা জেগে উঠছিল কুয়াশার মধ্যেও। একটা জায়গায় সামনের জন থামল। তারপর আস্তে ডাকল, “গবাদা।”
“হুঁ।”
“এই হল সেই জায়গা, যেখানে হরিহর খুন হয়। মনে আছে?”
“খুব মনে আছে।”
“আর সামনে ঐ সেই বাড়ি।”
“জানি।” দুজনে চুপ করে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। এবার গবা ডাকল, “গোবিন্দ।”
“বলো।”
“হরিহরকে খুন হতে আমি দেখেছি। তবে খুনিকে দেখিনি। আর দেখিনি
বলেই সাক্ষ্যও দিইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি। সাক্ষ্য দিলে তুই নির্দোষ মানুষ হয়তো খালাস পেসি।”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “না, গবাদা। খালাস হলেও ওরা আমাকে ছাড়ত না। জেলখানাতেও ওদের লোক আছে। বিরাট দল। ফাঁসিতে না ঝুললেও খুন হতাম।”
দুজনে বাতাসের মতো ফিসফিস করে কথা বলছিল। এত আস্তে যে, চার হাত দূর থেকেও শোনা যায় না।
গবা আর গোবিন্দ আর একটু এগিয়ে গেল। তারপর গোবিন্দ বলল, “গবাদা, এইবার।”
গবা গলাটা সাফ করে নিল একটু। তারপর হঠাৎ বেশ চেঁচিয়ে গান ধরল, আজ মনটা করে উড়ন খুড়ন গা করে আইঢাই। কাশিমের চবে দেখি জনমানব নাই। আছে শুধু বিজ্ঞপক্ষী আর যতেক ভক্তজন। ইংগিতে কয় কথা পাখি, তা বুঝেছেন কজন। আয় রে যত নন্দীভৃঙ্গী, তোদের ডাকে হরিহর। পাখির পেটে কথা করে খচরমচর। আছে গুরু আছে জ্ঞান কিন্তু শিষ্য নাই। বিজ্ঞপক্ষী গোমড়া মুখে বসে থাকেন তাই।
গান শেষ হলে দুজনে উৎকর্ণ হয়ে বসে থাকে। অনেকক্ষণ কেটে যায়।
গোবিন্দ বলে, “ওরা বোধহয় এদিকে আসেনি গবাদা।”
গবা হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল তোলে।
কাছে-পিঠে জঙ্গলের মধ্যে সড়সড় শব্দ হয় একটু। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কে বা কারা আসছে।
.
২২.
দুজনে নিঃসাড়ে বসে আছে। অপেক্ষা করছে। টের পাচ্ছে, আড়াল থেকে কেউ নজর করছে তাদের দিকে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও একদম সামনে কেউই এগিয়ে এল না।
“গবাদা।”
গোবিন্দ ফিসফিস করে বলল। “বলে ফ্যাল।”
“ওরা আমাদের মাপজোখ করছে। কাছে আসছে না।”
“তাই তো দেখছি। কিন্তু এই কুয়াসা আর অন্ধকারে মাপজোখটা কীভাবে?”
“সেও তো কথা। আর আমরাই বা উজবুকের মতো লুকিয়ে আছি কেন? ওরা যে খুঁজে পাবে না আমাদের।” বলে গোবিন্দ উঠতে যাচ্ছিল।