উদ্ধববাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “হুঁ! ঠিক আছে, এখন গিয়ে দু’সের ময়দা মাখ ভাল করে। ডাকাতদের ব্যবস্থা আমি করছি।”
নয়নকাজল উদ্ধববাবুর কাঁধে বসা পাখিটার দিকে কটমট করে একবার চেয়ে ময়দা মাখতে গেল।
.
২০.
গতকাল রাতে কাকাতুয়াকে চুরি করতে ডাকাত এসেছিল কিন্তু চুরি করতে পারেনি। সকালে কাকাতুয়াকে লুচি খাইয়ে উদ্ধববাবু থানায় গেলেন। এতকাল এ-ব্যাপারে পুলিশকে জড়াননি তিনি। কিন্তু রাত্তিরে যা হয়ে গেল তাতে তিনি ভাবনায় পড়েছেন। ডাকাতদলকে ঠেকানো তো একার কাজ নয়।
উদ্ধববাবু উকিল হিসেবে খুবই ডাকসাইটে। সবাই তাকে খাতিরও করে। কুন্দকুসুমও করতেন। কিন্তু রাত্রির ঘটনার পর আজ যেন উদ্ধববাবুকে তিনি বিশেষ পাত্তা দিতে চাইছিলেন না। ঘটনাটা শুনে বরং হোঃ হোঃ করে খানিক হেসে বললেন, “একটা পাখির জন্য সাতটা ডাকাত কাল আপনার বাড়ি চড়াও হয়েছিল, এ-কথা নিতান্ত আহাম্মক ছাড়া কে বিশ্বাস করবে বলুন!”
উদ্ধববাবুও জানেন, পাখির জন্য ডাকাতি হয় এ-কথা কেউ বিশ্বাস করবে। কিন্তু তাঁর পাখিটা যে গুপ্তধনের সন্ধান জানে এ-কথাটাও তিনি ফাস করতে চান না। গলাখাঁকারি দিয়ে তিনি বললেন, “পাখিটা আসলে খুব দামি। রেয়ার টাইপের জিনিস।”
কুন্দকুসুম ভ্রূ কুঁচকে উদ্ধববাবুকে একটু দেখে নিয়ে ফিচেল হাসি হেসে বললেন, “একটা খুব রেয়ার পাখিরও দাম নিশ্চয়ই এত বেশি হতে পারে
যার জন্য বাড়িতে ডাকাত পড়বে। আপনি কি আমাকে ছেলেমানুষ পেলেন উদ্ধববাবু?”
কথাটা যুক্তিযুক্তই। কিন্তু কুন্দকুসুম তো আর গোপন কথাটা জানেন না। উদ্ধববাবু তাই মাথা চুলকে বললেন, “সে যাই হোক, আমার বড় ভয় করছে। আজ রাত থেকে আমার বাড়িতে দুজন আর্মড গার্ড যদি রাখেন তবে বড় ভাল হয়।”
কুন্দকুসুম মাথা নেড়ে বললেন, “অসম্ভব। আমার হাতে যে ফোর্স আছে তা নিতান্তই সামান্য। তার ওপর এই থানার সব জায়গায় রিসেন্টলি ক্রাইম ভীষণ বেড়ে গেছে। ইন ফ্যাক্ট একজন ফেরারি খুনি আসামীর জন্য আমাকে সদর থেকে এক্সট্রা ফোর্স আনতে হচ্ছে। আপনি যত বড় উকিলই হোন উদ্ধববাবু, এই অবস্থায় আপনার পোষা পাখিকে পাহারা দেওয়ার জন্য লোক দিতে পারব না। মাপ করবেন!”
উদ্ধববাবু মরিয়া হয়ে বললেন, “ডাকাত যে পড়েছিল তার কিন্তু সাক্ষী আছে। তারা দরকার হলে আদালতে বলবে যে, আপনি আমার বিপদ জেনেও প্রোটেকশন দেননি।”
“বটে!” বলে কুন্দকুসুম সোজা হয়ে বসে কটমট করে উদ্ধববাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “আপনি আমার বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন বলে ভাবছেন। কারা সাক্ষী আছে বলুন তো! আমি তাদের স্টেটমেন্ট নেব।”
“গবা আছে, আমার ছোট ছেলে রামু আছে, জাফরচাচা আছে।”
কুন্দকুসুম বাজখাই গলায় আবার হাঃ হাঃ করে হাসলেন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, “রামু বা জাফরচাচা সাক্ষ্য দেবে না। ওরা কিছু দেখেনি। বরং সাক্ষ্য দিলে ওরা উলেটো কথাই বলবে। এরা বলবে যে, আপনি বিপজ্জনক এক অস্ত্র নিয়ে বহু লোকের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলেন, বিকট চিৎকার করে লোকের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন।”
“ওরা দেখেননি!” চিন্তিত উদ্ধববাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “কিন্তু গবা তো দেখেছে।”
“গবাকে সাক্ষী দাঁড় করালে দেশসুদ্ধ লোকের কাছে আপনি হাস্যাস্পদ হবেন। কারণ সবাই জানে গবা বদ্ধ উন্মাদ। পাগলের সাক্ষ্য টেকে না, উকিল হয়ে এটা আপনার জানা উচিত ছিল।”
উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠলেন।
কুন্দকুসুম পিছন থেকে তিক্তমধুর গলায় বললেন, “সকালে আপনি রটিয়েছিলেন যে, আপনার পাখিটা চুরি গেছে বা ডাকাতি হয়েছে। কিন্তু আমি খবর রাখি যে, পাখিটা এখনো আপনার কাছেই আছে।”
উদ্ধববাবু কী একটা বলতে গেলেন, কিন্তু শেষ অবধি বললেন না। বলে লাভও নেই। এই মাথামোটা লোকটা তাকে বিশ্বাস করবে না। আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি থানা থেকে বেরিয়ে এলেন।
পাখিটার জন্য আজ রাতে ডাকাতরা আর একবার হানা দিতে পারে। সুতরাং সন্ধের আগেই উদ্ধববাবু তৈরি হতে লাগলেন। তবে অসুবিধে দেখা দিল লোকজন জোটানোর বেলায়। জাফরচাচাকে বলতে গিয়েছিলেন উদ্ধববাবু, “চাচা, আজও আমার সঙ্গে রাতটা গল্পগুজব করে কাটাবেন নাকি?”
জাফর মিঞা আঁতকে উঠে বললেন, “কানে শোনার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছি ভাই, সেটা আবার হারাতে চাই না। তাছাড়া আজ বাতের ব্যাথাটাও চাগাড় দিয়েছে।” |||||||||| উদ্ধববাবু রামুকে ডাকাডাকি করলেন, কিন্তু তার সাড়া পাওয়া গেল না। এমন কি নয়নকাজলকে পর্যন্ত ডেকে গলা ভেঙে ফেললেন। “কোথায় যে সব থাকে!” বিরক্ত হয়ে এই কথা বলে সন্ধেরাত্রিতেই উদ্ধববাবু বন্দুক কাঁধে নিয়ে বাড়ির চারদিকটা টহল দিলেন। টর্চ জ্বেলে বাড়ি সবচেয়ে দুর্বল অংশ কোটা এবং কোথা দিয়ে ডাকাতরা বাড়িতে ঢুকতে পারে তা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলেন। বাড়িটা তার খুবই মজবুত এবং নিরাপদ। কিন্তু তা বলে কি আর রন্ধ্র থাকতে পারে না! লখিন্দরের বাসরঘরেও তো র ছিল।
ওদিকে তার স্ত্রী এবং অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও বাড়ির চারদিকে সার্চ করতে লেগে গেছে।
উদ্ধববাবু খিড়কির দরজাটা পেরেক দিয়ে একেবারে সেঁটে দিলেন, তারপর কয়েকটা পাথরের চাই এনে ঠেকা দিলেন তাতে। বাড়ির চারদিকে উঁচু পাঁচিলের
ওপর উঠে কাঁটাতার বিছিয়ে দিলেন। আর সামনের বারান্দায় সরষের তেল ঢাললেন। অনেকগুলো কলার খোসা ছড়িয়ে রাখলেন। ডাকাতরা হুড়মুড় করে এলে যাতে আছাড় খায়। কেলেহাঁড়ি দিয়ে একটা কাকতাড়ুয়াও বানালেন। সেটাকে সামনের দরজার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন।