“সারকাস ছাড়া যে আমি বাঁচব না।” বলে গোবিন্দ সামন্তর বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। তার চোখে জল।
সামন্ত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “কী যে গেরোয় পড়েছিস বাবা। ভগবান তোকে কেন এমন বিপদে ফেলল তাও বুঝি না। ভাল লোকেরাই দেখছি এই দুনিয়ায় সবচেয়ে হতভাগ্য।”
গোবিন্দ মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটু কাঁদল। তারপর মুখ তুলে বলল, “আপনি আমার বাবার মতো আপনাকেই তাই বলতে বাধা নেই। আমি ভাল লোক নই সামন্তমশাই।
সামন্ত চোখ বড়-বড় করে বলে, “তোকে আমি এইটুকু বয়েস থেকে জানি। বলতে কি আমার কাছেই প্রতিপালিত হয়েছিস। কোনোদিন চুরিটুরি করিস নি, মিথ্যে কথা বলিস নি, লোকে বিপদে পড়লে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য করেছিস, তবু তুই ভাল লোক নোস, এ আবার কেমন কথা?”
গোবিন্দ চোখের জল মুছে বলে, “সে-সব আপনিই শিখিয়েছেন। ভাল লোকের কাছে থাকলে লোকে সৎ শিক্ষাই পায়। কিন্তু কয়লা ধুলে কি ময়লা যায়? আমার ভিতরে যে গরল ছিল।”
“সে আবার কী কথা?”
গোবিন্দ ধীর গম্ভীর গলায় বলে, “হরিহরকে আমি খুন করি নি বটে, কিন্তু আমার মনে পাপ ছিল। গুপ্তধনটা খুঁজে পেলে আমার ইচ্ছে ছিল, হরিহরকে খুন করে সবটুকু আমি হাতিয়ে নেব। তারপর সেই টাকায় নিজের একটা সারকাসের দল খুলব।”
“বটে।” সামন্ত একটু বিষমুখে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমি তো তোকে অনেকবার বলেছি, আমি মরলে এই সারকাস তোরই হবে। আমি জানি, তোর মাথায় ব্যবসা করে টাকা রোজগারের মতলব নেই। সারকাস একটা আনন্দের জিনিস। লোকের কাছ থেকে পয়সা আমরা নিই বটে কিন্তু সেটাই কথা নয়। বড় কথা হল, ছোট-ঘোট ছেলে মেয়েদের মধ্যে সাহস আর আনন্দ জাগিয়ে তোলা আর নিজেরাও তা থেকে আনন্দ পাওয়া। লোভ থাকলে ভাল খেলোয়াড় হওয়া যায় না, ভাল মানুষ হওয়া যায় না। তার হঠাৎ লোভ এল কোথা থেকে?”
“লোভটা বাইরে থেকে আসে না, সামন্তমশাই। লোভ মানুষের ভিতরেই থাকে।” গোবিন্দের চোখে আবার জল। চোখ মুছে সে বলল, “হরিহরকে খুন করার কথা ভেবেছিলাম দুটো কারণে। একে তো হরিহরের মতো বদমাশ দুটো নেই। আর একটা কারণ হল, আমি ওকে খুন না করলে ও-ই আমাকে খুন করত।”
সামন্ত চোখ ছোট করে খুব একদৃষ্টে গোবিন্দর দিকে চেয়ে ছিল। বলল “তোর সঙ্গে হরিহরের চেনা-পরিচয় হল কী করে?”
“হরিহরকে সবাই চিনত। আমরা যখন কাশিমের চরের কাছে খেলা দেখছিলাম তখন একদিন হরিহর আমার কাছে লুকিয়ে আসে। আমাকে বলল, সে এক জায়গায় গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। আমি যদি সেই গুপ্তধন উদ্ধারে তাকে সাহায্য করি তাহলে সে আমাকে অর্ধেক বখরা দেবে। গুপ্তধনের কথা গুনেই প্রথম আমার ভিতরে লোভ জেগে উঠল।”
“সন্ধান পেয়েছিলি?”
“না। গুপ্তধনটা ছিল এক বুড়ির। সে সম্পর্কে হরিহরের পিসি হয়। সেই বুড়ির তিন কুলে কেউ নেই? এমন-কী সেই গুপ্তধনও নাকি বুড়ি চোখে দেখে নি। তবে সন্ধানটা সে-ই জানত। বুড়ি একটা কাকাতুয়া পুষত, আর সেটাকে নিজের ছেলের মতো ভালবাসত। গোপনে নাকি বুড়ি কাকাতুয়াটাকে সেই গুপ্তধনের সন্ধান শিখিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আর কাউকে বলত না। হরিহর বুড়ির গুপ্তধনের সন্ধান জানার জন্য বিশু নামে নিজের এক সাকরেদকে পিসির বাড়িতে চাকরের কাজ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বিশুও কোনো সন্ধান রে, করতে পারে নি। তবে একদিন বিশু কাকাতুয়াটাকে চুরি করে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে হরিহর বিশুর পিছু ধাওয়া করে এক মাঠের মধ্যে তাকে খুন করে। কিন্তু বিশু খুন হওয়ার আগে পাখিটার পায়ের শিক্লি খুলে উড়িয়ে। দেয়। ওদিকে হরিহরের পিসি কাকাতুয়ার শোকে মারা যায়। তবে মরার আগে সে যখন ভুল বকছিল তখন হরিহর সেইসব কথা থেকে গুপ্তধনের জায়গাটা আঁচ করে ছিল। কিন্তু তা উদ্ধার করা বড় সহজ কাজ ছিল না। তাই আমার কাছে এসেছিল হরিহর।”
“তারপর কী হল?”
“সে অনেক ঘটনা। কাশিমের চরে একটা মস্ত পুরনো বাড়ি আছে। সেই বাড়ির অনেকগুলো গম্বুজ আছে। কোনো গম্বুজেই উঠবার কোন সিঁড়ি নেই। আর এমন সমান করে তৈরি যে কোন খাজ-টাজও নেই যা বেয়ে ওঠা যায়। হরিহর বলেছিল তার মধ্যে একটা গম্বুজের মাথায় নাকি একটা ঢাকনা নীচে গভীর এক কুয়োর মুখ। গম্বুজের মাথা থেকে সেই কুয়ো নেমে একেবারে মাটির তলায় চলে গেছে। আর মাটির তলায় কোনো কুঠুরীতে আছে সেই গুপ্তধন। সেই কুঠুরিতে পৌঁছানো খুব শক্ত কাজ। সারকাসের খেলোয়াড় ছাড়া সে-কাজ করার সাধ্য খুব কম লোকের আছে।”
“তুই হরিহরের কথায় রাজি হলি?
“প্রথমে হইনি। পরে লোভ হল। ভীষণ লোভ। মনে হল, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার এমন সুযোগ আর পাব না।”
“তা বলে খুনের কথা ভাববি?”
“লোভ একটা নেশার মতো সামন্তমশাই, যখন ঘাড়ে চাপে তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না।”
“তারপর কী হল?”
“কথা ছিল, আমি সন্ধেবেলা সেই পোড়ো বাড়িতে হাজির থাকব। হরিহর আসবে। কিন্তু সে সময়তো এল না। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই বাড়িতে বহু গম্বুজ। কোটা যে গুপ্তধনের সুড়ঙ্গ তা তো জানি না। হরিহর এসে চিনিয়ে দেবে। কিন্তু সে আর হল না। কাশিমের চরে অন্য একদল বদমাশের হাতে হরিহর খুন হয়ে গেল সেই রাতে। আমার চোখের সামনেই ঘটনা। দোষের মধ্যে আমি গিয়ে হরিহরের লাশটাকে নাড়াচাড়া করেছিলাম, বেঁচে আছে কিনা দেখতে। যদি তার কাছ থেকে কোনো কথা আদায় করা। যায়। ঠিক সেই সময়ে কিছু লোক এসে পড়ল সেখানে। ধরা পড়ে গেলাম।”