অনেকক্ষণ বাদে যখন চোখ মেললেন তখন তিনি ঠিক বাস্তবজগতে নেই। নিজের সুরের রেশ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বেশ অনেকটা সময় গেল ধাতস্থ হতে। তখন অবাক হয়ে দেখেন, রামু উঠে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। জাফর মিএ ঘন-ঘন চোখের জল মুছছেন। বারান্দায়, সামনের বাগানে, ডাইনে বাঁয়ে বিস্তর পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হয়েছে। প্রত্যেকেই হাঁ করে দেখছে তাকে।
উদ্ধববাবু একটু লজ্জা পেলেন। গান তিনি ভালই গেয়ে থাকেন বটে, কিন্তু এত রাতে লোক জড়ো হওয়ার মতো ততটা কি? যাই হোক, তিনি হাতজোড় করে শ্রোতাদের নমস্কার জানালেন।
ঠিক এই সময়ে বেরসিক গবা পাগল বলে উঠল, “আপনি তো গানের ঠেলায় পাড়া জাগালেন। ওদিকে যে হয়ে গেছে।”
উদ্ধববাবু মিটিমিটি হেসে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করেন, “কী হল রে আবার?”
“আবার কী?” যেনাদের আসবার কথা ছিল তেনারা এসে কাজ হাসিল করে হাওয়া।
উদ্ধববাবুর মাথাটা আজ বড় ভাল। এই শীতের রাতে গান গেয়ে তিনি সকলের ঘুম ভাঙিয়েছেন। তার সুরের চুম্বকে সকলে ছুটে এসেছে। এই সাফল্যের পর তার এলেবেলে কথা ভাল লাগছে না। তবু গলাটা মিষ্টি রেখেই বললেন, “আরো লোক এসেছিল বুঝি? তা বসতে দিলি না কেন?”
“তারা বসবার জন্য এলে তো বসতে বলব! তারা কাজ গুছোতে এসেছিল, কাজ গুছিয়ে সরে পড়েছে।
তাই নাকি?” উদ্ধববাবু তবু গা করেন না।
গবা পাগলা বলল, “আমিও গোয়ালঘরের চালে বসে পাহারা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি আপনি তরোয়াল ঘুরিয়ে গান ধরেছেন। তরোয়ালের ডগাটা একবার রামুর পেটের ধার ঘেষে গেল, আবার জাফরচাচার নাকের ডগা ছুঁয়ে এল। মারাত্মক কাণ্ড। ভাবছি নেমে এসে আপনাকে জাপটে ধরি। ঠিক এই সময়ে নোরা এলেন। পাঁচ-সাতজন তাগড়া জোয়ান। আপনি চোখ বুজে গানে মত্ত।“
তারা আপনার চোখের সুমুখ দিয়ে, বগলতলা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল যন্ত্র দিয়ে, তারপর চোখের পলকে পাখির দাঁড়টা নিয়ে আপনার সুমুখে দিয়েই বেরিয়ে গেল। গান যে কী সবর্বনেশে তা আজ বুঝলাম।
উদ্ধববাবু এখনো সঙ্গীতের সুরলোক থেকে নেমে আসতে পারেননি। চোখে এখনো ঘোর। মিষ্টি করে বললেন, “পাখি নিয়ে গেছে? যাক। পাখি যাক, সুর তো ধরা দিয়েছে। তুই বরং রাঘব ঘোষকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়।”
লোকজনের ভিড় ঠেলে হঠাৎ দারোগা কুন্দকুসুম বারান্দায় উঠে এলেন। মুখ গম্ভীর। বললেন, “উদ্ধববাবু, আপনার মতো বিশিষ্ট লোককে হ্যাঁরাস করতে চাই না। কিন্তু আপনার পাড়া প্রতিবেশীদের কয়েকজন গিয়ে আমার কাছে অভিযোগ করেছেন যে আপনি গভীর রাতে বিকট চিৎকার করে তাদের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন। ইন ফ্যাক্ট, আমিও থানা থেকে একটা চেঁচানি শুনতে পেয়েছি। প্রতিবেশীরা আপনাকে থামানোর জন্য এসে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু আপনি একটি বিপজ্জনক অস্ত্র ঘোরাচ্ছেন দেখে তারা কেউ কাছে আসতে ভরসা পাননি। তাদের ধারণা, আপনি পাগল হয়ে গেছেন। আপনার বিরুদ্ধে বিপজ্জনক অস্ত্র রাখা ও ব্যবহার এবং লোকের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটানোর দু-দফা অভিযোগ। আমি আপনাকে গ্রেফতারও করতে পারি। কিন্তু অতটা না-করে আজ কেবল একটা ওয়ার্নিং দিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আর এরকম করবেন না।“
কুন্দকুসুম চলে যাওয়ার পর উদ্ধববাবু সুরলোক থেকে দড়াম করে বাব জগতে নেমে এলেন। কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে তিনি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, “পাখিটা তবে নিয়ে গেছে?”
গবা বলল, “তবে আর বলছি কী?”
উদ্ধববাবু খিঁচিয়ে উঠলেন, “তবে চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে গেল, তুই কিছু করলি না?”
গবাও সমান তেজে বলে, “সে তো আপনারও চোখের সামনেই নিয়ে গেছে। আমাকে দোষ দিচ্ছেন শুধু-শুধু। আমি একা অতজনের সঙ্গে পারব কেন?”
“চেঁচাতে তো পারতিস!”
গবা হেসে বলে, “আজ্ঞে, আপনার গানের চোটে আর সব শব্দ তো লোপাট হয়ে গিয়েছিল আমার চেঁচানি শুনবে কে? তবু চেঁচিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার গলার দাপটে আমার চেঁচানি ঢাকা পড়ে গেল।”
জাফর মিঞা হঠাৎ একগাল হেসে বললেন, “উদ্ধব আমি বেশ শুনতে পাচ্ছি। বুঝলে! হঠাৎ কানের ভিতরকার ঝিঝি ভাবটা কেটে গেছে।”
উদ্ধববাবু কটমট করে তাকিয়ে বলেলেন, “তাই নাকি?”
ওঃ তোমার গান যে কী উপকারী তা আর বলার নয়। প্রথমটায় একটু আঁতকে উঠেছিলাম বটে। কিন্তু তার পর থেকেই কান ভেসে যাচ্ছে হাজার রকম শব্দে।
‘‘ বলে উদ্ধববাবু তবোয়াল-হাতে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিলেন। রক্ত না-খাইয়ে তরোয়াল খাপে ভরা বারণ। উদ্ধববাবু তরোয়ালটার দিকে চেয়ে বললেন “খাওয়াচ্ছি রক্ত। নে খা।”
বলে তরোয়ালটা দিয়ে নিজের কণ্ঠনালী চেপে ধরলেন।
.
১৮.
ভোর রাত্রে সামন্তমশাইয়ের তাঁবুতে একটা লোক ঢুকল। চাপা গলায় ডাকল, “সামন্তমশাই!”
সামন্ত ঘুম পাতলা। এক ডাকেই জেগে লক্ষ্যটা উসকে দিয়ে বলে “কে?”
“আমি গোবিন্দ। শুনলাম সারকাস এখান থেকে চলে যাচ্ছে।”
সামন্ত একটা শ্বাস ফেলে বলে, “রাত ভোর হলেই গোছগাছ শুরু হবে। বেলাবেলিই রওনা হওয়ার কথা।”
“আমি কি পড়ে থাকব এখানে? আমাকেও সঙ্গে নিন।”
সামন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তোকে না নেওয়া কি আমার ইচ্ছে? কিন্তু পুলিশ কড়া নজর রাখছে। যেখানে যাব সেখানেও রাখবে। লুকিয়ে থাকতে তো পারবি না।”
“তাহলে?”
“তাহলে যে কী তা আমার মাথায় খেলছে না। রোজই তোর কথা ভাবি। কিন্তু কোনো ফন্দিফিকির খুঁজে পাচ্ছি না!”