গেরার মেজো ছেলে অভিমানভরে বলল, “কিছুই তো আমাকে বলছ। কিন্তু আমি যে তোমাকে খুব ভালবাসতাম।”
গোবিন্দ একটু ভাবল। তারপর বলল, “বেশ কিছুদিন আগে কাশিমের চরে একটা লোক খুন হয়েছিল। তার নাম হরিহর পাড়ুই। জানো?”
“জানি। সারকাসের খেলোয়াড় মাস্টার গোবিন্দর তো সেই জন্যই ফাঁসি হবে।”
“হয়নি। কারণ আমিই গোবিন্দ মাস্টার।”
“তুমি?” বলে যেন ভূত দেখে আঁতকে ওঠে ছেলেটা।
গোবিন্দ তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “খুনটা যে আমি করিনি সেটা অনেকেই বিশ্বাস করে না। তবে হরিহরের সঙ্গে সেই রাতে কাশিমের চরে আমি গিয়েছিলাম বটে।”
“তবে কে খুনটা করল?”
“তা জানি না। কিন্তু জানতেই হবে। যেমন করেই হোক। খুনিকে ধরতে না পারলে পুলিস শেষ পর্যন্ত আমাকে ধরবেই।”
“তাহলে তুমি পালাও।”
“তাই পালাচ্ছি।”
.
১৭.
উদ্ধববাবু ঠিক করলেন আজকের রাতটা জেগে পাহারা দেবেন। বাড়ির লোকেরা খুব-একটা রাত জাগাতে আগ্রহী নয়। চাকরবাকরেরা দায়ে পড়ে জাগবে বটে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস
নেই! উদ্ধববাবু একাই জাগবেন বলে ঠিক ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর দুজন সঙ্গী জুটে গলে। একজন তার ছোট ছেলে রামু। বাচ্চাদের রাত জাগা উদ্ধববাবু পছন্দ করেন না বটে, কিন্তু রামুটা বেস ডাকাবুকা আছে, গুলতির হাতটাও বেশ পাকা। লেখাপড়ায় বুদ্ধি না খুললেও অন্যান্য ব্যাপারে যে রামুর বুদ্ধি খুব চটজলদি খেলে তা উদ্ধববাবু জানেন। কাজেই রামু যখন বাবার সঙ্গে পাহারা দেওয়ার প্রস্তাব করল তখন তিনি খুব-একটা আপত্তি করলেন না। কটমট করে ছেলের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, “ফুলহাতা সোয়েটার পরে, মাথায় কানে বেশ করে কমফর্টার জড়িয়ে নেবে। পায়ে জুতো মোজা থাকে যেন।” দ্বিতীয় সঙ্গী জুটল নবৃহ বছরেরর জাফর মিঞা। বয়স নবৃই হলেও জাফর মিঞার শরীরটি মেদহীন, দীর্ঘ এবং খুবই কর্মক্ষম। তিনি সামান্য দুধ আর ফল ছাড়া অন্য কোনো খাবার খান না। দিনে পাঁচবার নমাজ পড়েন। তাঁর মাথাটি ঠাণ্ডা, মেজাজটি ঠাণ্ডা, মুখে সর্বদা হাসি। তবে জাফর মিয়া কানে কম শোনেন। উদ্ধববাবুকে সেই ছোট অবস্থা থেকে দেখে আসছেন। সেই উদ্ধববাবুর বাড়িতে ডাকাত পড়বে শুনে তিনি নিজেই যেচে একটা লাঠি হাতে চলে এলেন। গাল কান মাথা ঢাকা বাঁদুরে টুপি, মোটা কম্বল আর নাগরা জুতোয় তাকে বেশ জম্পেশ দেখাচ্ছিল।
উদ্ধববাবু নিজেও সঙ্গে একটা অস্ত্র রাখলেন। বহুকাল আগে তার এক রাজপুত মক্কেল মামলায় জিতে একটা তরোয়াল উপহার দিয়েছিল। বংশের স্মৃতিচিহ্ন। তরোয়ালটা বেশ লম্বা আর ভারী। রাজপুত বলেছিল, এই তলোয়ার যদি খোপ থেকে কখনো বের করেন তবে রক্ত না খাইয়ে খাপে ভরবেন না। আজ পর্যন্ত এই তলোয়র রক্ত না খেয়ে খাপে ঢোকেনি কখনো। এমনি রক্ত না জোটে তো কুকুর-বেড়াল পোকামাকড় যা হোক একটা মেরে নিয়মটা রাখবেন।
উদ্ধববাবু রক্ত খাওয়ানোর কথা শুনে তরোয়ালটা কখনও খাপ থেকে বের করেননি। আজ করলেন। দেখে অবাক হলেন, দশ বছর খাপের মধ্যে একটানা বন্ধ থেকেও তলোয়ারটার গায়ে একটু মরচে পড়েনি। এখনো ঝকঝক
করছে। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার, অস্ত্রটা হাতে নিলেই শরীরের রক্ত কেমন একটু চনমন করে ওঠে। ঘোড়ার পিঠে চেপে এক্ষুনি যুদ্ধযাত্রায় পড়তে ইচ্ছে করে।
কিন্তু উদ্ধববাবুর ঘোড়া নেই। ধারেকাছে কোথাও কোনো যুদ্ধও হচ্ছে না। তাই তিনি শূন্যে কয়েকবার তলোয়ারটাকে ঘুরপাক খাইয়ে নিলেন। মনে দুর্জয় সাহস এল।
রাত এগারোটার পর তিনজন বাইরের বারান্দায় শতরঞ্চি পেতে বসলেন। ফ্লাক্সে চা, টিফিন ক্যারিয়ারে লুচি আর আলুর দম। তিনটে নতুন ব্যাটারি ভরা টর্চ।
জাফর মিঞা বললেন, “পুলিশে একটা খবর দিয়ে রাখলে পারতে হে উদ্ধব। বদমাশগুলো যদি দেল বেঁধে আসে তাহলে আমরা তিনজন কী করব?”
উদ্ধববাবু বলেন, “সেটা একবার ভেবেছিলাম। তবে একটা পাখির জন্য পুলিশ পাহার বসালে লোকে আমাকে পাগল ভাববে। তাই অতটা আর করিনি! এমনিতেই আজ আদালতে আমার সম্পর্কে একটু সন্দেহ প্রকাশ করেছেন হাকিম।”
ভালমানুষ জাফর মিএ কী বুঝলেন কে জানে। শুধু বললেন, “ ভাল। ভাল।”
রাত বারোটার মধ্যেই জাফর মিঞা ঢুলতে লাগলেন। রামু প্রথম দিকটায় তেজে পাহারা দিচ্ছিল। কিন্তু বাচ্চা ছেলে, হঠাৎ কোন সময়ে শতরঞ্চিতে কোণ ঘেঁষে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। উদ্ধববাবু একা।
তবে একা হলেও ভয়ের লেশমাত্র তিনি টের পাচ্ছেন না। হাতের তরোয়ালটা ঝকঝক করছে। শরীরের রক্ত এতই গরম হয়ে উঠেছে যে এই শীতেও তার ঘাম হতে লাগল। তিনি প্রথমে আলোয়ানটা খুললেন, তারপর সোয়েটার ছেড়ে ফেললেন। তাতেও গরম বোধ করায় গায়ের জামাটা খুলে সেটা ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে লাগলেন। গায়ের গেঞ্জিটাও ভিজে গেছে ঘামে। সেটাও খুলবেন কিনা ভাবছেন, এমন সময় থানার ঘড়িতে একটা বাজবার ঢং শব্দ হল। উদ্ধববাবু তরোয়াল-হাতে পায়চারি করতে করতে দরবারি কানাড়া রাগের একটি মুড তৈরি করতে লাগলেন। ভারী গভীর এবং গম্ভীর রাগ। তার গলায় রাগটা খোলেও ভাল। গাইতে গাইতে বেশ আত্মহারা হয়ে গেলেন তিনি। পাখির কথা মনে রইল না, পাহারার কথা মনে রইল না। সুরের ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের তরোয়ালটাও উঠছিল নামছিল। পা পড়ছিল লেতালে। চোখ বোজা। উদ্ধববাবু স্পষ্টই টের পাচ্ছিলেন, আজ র গলায় অন্য কেউ ভর করেছে। এ যেন তার সেই পুরানো গলাই নয়। সুরের এক মায়ারাজ্য থেকে রাগরাগিণীর বাতাস ভেসে আসছে। চারদিকে এক সুরের সম্মোহন ছড়িয়ে যাচ্ছে।