গোবিন্দ প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু খুঁটির মাথায় দাঁড়িয়ে ইষ্টদেবকে স্মরণ করে জীবনের সবেচেয় বড় লাফটা মারল।
১৬-২০. লাফের চোটে গোবিন্দ
লাফের চোটে গোবিন্দ তিরিশ ফুট খুঁটির ওপরে আরও চারফুট উঁচুতে উঠে গেল। ধনুকের মতো বাঁকা পথে আগুনের বেড়াজাল টপকে গিয়ে পড়ল আরও অন্তত সোল সতেরো ফুট দূরে। অন্য কেউ হলে এই বিশাল লাফের পর মাটিতে আছড়ে পড়ে হাড়গোড় ভেঙে দ হয়ে থাকত। কিন্তু গোবিন্দ পড়ল বেড়ালের মতো প্রায় নিঃশব্দে, এবং বিনা দুর্ঘটনায়।
পড়ে সে আগুনের দিকে চেয়ে দেখছিল। এত বড় আগুন সে বহুকাল দেখেনি। গেরস্তর খড়ের গাদাগুলো সবই বিশাল। আগুনটাও তেমনি বিকট হয়ে আকাশ ছুঁয়ে চলেছে। তার চেয়েও বড় কথা, একটু দূরে-দূরে আরও দুটো খড়ের গাদা আছে। আগুনটা যেরকম ফুলকি ছড়াচ্ছে, আর শিখা যেমন উত্তরে বাতাসে দক্ষিণামুখো বেঁকে যাচ্ছে, তাতে আর দুটো গাদা আর গেরস্তর বাড়িতেও আগুন ধরল বলে।
গেরস্ত তার বাড়ির মেয়েপুরুষ মিলে পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে “গেল, গেল সব গেল! জল দে, জল দে শিগগিরি।”
কিন্তু এই শীতে টানের সময় খালবিল শুকিয়ে দড়ি। কুয়োর জল পাতালে। এই বিশাল আগুন নেভানো সহজ কর্ম নয়। মুনিশরা লাঠি দিয়ে খড়ের গাদায়। পেটাপটি করেছিল বটে, কিন্তু আগুনের তাতে ঝলসে সবাই হটে এল।
অত আগুনের আলোয় চোখ ঝলসে গেছে বলে গোবিন্দর হনুমান লাফটা কেউ লক্ষ করেনি। গেরস্ত বুক চাপড়ে চিৎকার করে বলছিল, বোবা-কালা অবোধ লোকটা সেদ্ধ হয়ে গেল রে। আহা বেচারি চেঁচানোরও সময় পায়নি।
গোবিন্দ পড়েছিল বেগুন-খেতের মধ্যে। সামনে ডালপালার বেশ উঁচু বেড়া। সুতরাং তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এই সময়ে হঠাৎ গোবিন্দর মাথায় একটি বুদ্ধি এল। খড়ের গাদায় আগুন লেগে সে মরেছে, একথাটা প্রচার হয়ে গেলে কেমন হয়? যারা তাকে মারতে চেয়েছিল তারা অন্তত কিছুদিন নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে।
গা-সুদ্ধ লোক আগুন দেখতে ধেয়ে আসছে। গোবিন্দর উচিত ছিল এই অবস্থায় গেরস্তকে কিছু সাহায্য করা। কিন্তু সে দেখল, এই আগুনকে কজায় আনা তার অসাধ্য। গেরস্তর কপাল ভাল থাকলে বাঁচবে।
এই ভেবে গোবিন্দ হামাগুড়ি দিয়ে বেগুন-খেতের পিছনে বাঁশের বন ডিঙিয়ে বাঁশবনে পড়ল। জিনিসপত্র কিছু পড়ে রইল বটে গেরস্তর বাড়িতে, কিন্তু সে তেমন কিছু নয়।
ঘুরপথে হেঁটে সে শহরের রাস্তায় উঠে পড়ল। খুবই অন্ধকার আর ঠাণ্ডা রাত। চারদিকে হিম কুয়াশা। গোবিন্দ তার গায়ের কথাটা পর্যন্ত আনেনি। শীতে একেবারে জমে যাচ্ছে। এই ঠাণ্ডা থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় খুব জোরে জোরে হাঁটা। গোবিন্দ হাঁটতে লাগল।
এতকাল ফাঁসির দড়ির ভয় ছিল। পুলিশের ভয় ছিল। এবার তার সঙ্গে এ আর এক অচেনা বিপদ এসে জুটল। সাতনা, কিন্তু আগুন যে সাতনাই দিয়েছে, তার কোনো মানে নেই।
তবে কে? গোবিন্দকে মেরে তার কী লাভ?
ভাবতে ভাবতে কুলকিনারা পায় না গোবিন্দ। সে বুদ্ধিমান বটে, কিন্তু আজকের আচমকা সব ঘটনায় বুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা মাথায় সবটা বিশ্লেষণ করতে পারছে না।
গাঁয়ের সীমানা ডিঙিয়ে যখন ভোলা মাঠে পা দেবে গোবিন্দ, তখন হঠাৎ পিছনে শুনল কে যেন দৌড়ে আসছে। তবে এক জোড়া পায়ের আওয়াজ।
গোবিন্দ একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেল। লোকটা শক্ত হলেও যদি একা হয় তবে গোবিন্দর ভয় নেই। যে-কোনো একজন লোকের সঙ্গে সে
অনায়াসে পাল্লা টানতে পারবে।
কে যেন ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে ডাকল, “রাখালদা! ও রাখালদা?”
গেরস্তর মেজো ছেলে। গোবিন্দ চাপা স্বরে বলল, “এখানে।”
কাছে এসে হাঁফাতে-হাঁফাতে সে জিজ্ঞেস করল, “পালাচ্ছ কেন?”
“না পালিয়ে উপায় নেই। তোমাদের বাড়িতে কি আগুনটা ছড়িয়েছে।
‘না। গাঁয়ের লোকেরা বড় বড় বাঁশ দিয়ে গাদার আগুন প্রায় ঠাণ্ডা করে এনেছে। খড়ের আগুন বেশিক্ষণ তো থাকে না।”
“আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম যে। মনে হচ্ছিল, তুমি অত সহজে মরবার পাত্র নও। ঠিক বেঁচে যাবে। তোমাকে লাফ দিয়ে বেগুন খেতে পড়তেও দেখেছি।”
“আর কেউ দেখেনি তো?”
“আমাদের বাড়ির কেউই দেখেনি তবে তুমি পালানোর পর লম্বা আর জোয়ান একটা লোক বেগুনখেতে গিয়ে টর্চ জ্বেলে কী যেন দেখছিল। সে এই গাঁয়ের লোক নয়।”
গোবিন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাতনা।
ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “লোকটা কে গোবিন্দ?”
“একটা দুঃখী লোক। দুঃখ অনেক সময় মানুষের ভাল করে। কখনো কখনো খারাপও করে। এ-লোকটার খারাপ করেছে।”
“তার মানে?”
“গল্পটা বলার তো সময় নেই। লোকটা কী করল বল।”
“কিছু করল না। খানিকক্ষণ চারদিক দেখে খুব গম্ভীর মুখে একদিকে চলে গেল।”
“সঙ্গে কাউকে দেখলে?”
“কাউকে না।”
“তাহলে ঐ লোকটাও জানে যে, আমি মরিনি!”
“তা জানতে পারে। কিন্তু আগুনটা দিল কে বলো তো। বাবার ধারণা তুমি বিড়ি খেতে গিয়ে নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছ। সত্যি নাকি?”
ম্লান হেসে গোবিন্দ বলে, “খেলোয়াড়দের বিড়ি সিগারেট খাওয়া বারণ জানো না?”
ছেলেটা অবাক হয়ে বলে, “তুমি খেলোয়াড় নাকি? কিসের। ‘সারকাসের। কিন্তু সে-গল্পও আর একদিন শুনো।”
“বাঃ রে, এসব কথা আমাকে বলোনি কেন? “তুমি ছেলেমানুষ। তোমাকে বিপদে ফেলতে চাইনি।”
“কিসের বিপদ?”
“এখন বলার সময় নেই।”