গোবিন্দ জেল পালানোর কথাটা ছেলেটাকে বলেনি। শুধু বদমাশ লোক তার পিছনে লেগেছে বলে সে লুকিয়ে আছে। গোবিন্দ জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা আমার কথা কিছু বলেননি তো?”
কিছু লোকের স্বভাব হল, বুদ্ধি থাকলেও তা খাটাবে না। ছেলেটা বলল, “দাঁড়াও, গিয়ে বাবাকে বাবাকে জিজ্ঞেস করে আসি।”
গোবিন্দ তাকে থামিয়ে বলল, “এখন ফের জিজ্ঞেস করলে তোমার বাবার সন্দেহ হবে। থাকগে।”
রামু মাঝে-মাঝে ছুটির দিনে গোরু চরানোর মাঠে খেলা শিখতে আসে। গোবিন্দ লক্ষ করেছে, ছেলেটা যেদিকে মন দেয় সেদিকটায় বেশ ধাঁ করে উন্নতি করে ফেলতে পারে। খালি মাঠে যন্ত্রপাতি ছাড়া রামুকে আর কীই বা শেখাতে পারে গোবিন্দ? তবু যে কয়েকটা মামুলি একসারসাইজ শিখিয়েছিল, তা চটপট শিখে নিল রামু। খেলা শেখার ফাঁকে-ফাঁকে দু-একটা খবরও দিত। সামন্ত বলে দিয়েছে, পুলিশ সারকাসের ওপর নজর রাখছে তো বটেই, কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হয় পুলিশ ছাড়া অন্যকিছু লোকও সারকাসের আশেপাশে ঘোরা-ফেরা করছে। আর একদিন এসে রামু জানিয়ে গেল, খুব শিগগিরই সারকাস এখান থেকে উঠে যাবে। গোবিন্দ যেন সারকাসের দলের সঙ্গে না যায়। এবার সারকাস যাবে অযযাধ্যার দিকে। পারলে গোবিন্দ যেন সেখানে গিয়ে দলে ভিড়ে যায়।
সারকাসের জন্য প্রাণটা বড় কাঁদে গোবিন্দর। চারদিক থেকে আলো এসে পড়ে, শূন্যে মাটিতে তার বা দড়ির ওপর হরেক রকম খেলা চলে, সঙ্গে অদ্ভুত ব্যাণ্ডের আওয়াজ–সে যেন এক স্বপ্নের জগৎ। তা ছাড়া সারকাস হল এক বৃহৎ পরিবার। সকলের জন্য সকলে। সেই সারকাসে আর ফিরে যাওয়া হবে কিনা কে জানে!
গোরু চরাতে-চরাতে এইসব ভাবে গোবিন্দ।
একদিন গোরু নিয়ে বিকেলবেলা ফিরছে, হঠাৎ দেখে গেরস্তর বাড়ির সামনে খুব লম্বা আর জোয়ান একটা লোক দাঁড়িয়ে গাঁয়ের আর-একটা লোকের সঙ্গে কী কথা বলছে, গোবিন্দ পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে শুনতে পেল গাঁয়ের লোকটা বলছে, “না, এ-গাঁয়ে খুনি গুণ্ডা বদমাশ আসবে কোথকে? সে সব শহরে থাকে।”
লম্বা লোকটা বলল, “হয়ত পালিয়ে আছে।”
“পালানোর জায়গা কোথায়?”
“আচ্ছা গবা বলে কাউকে চেনো?”
“খুব চিনি। গবা পাগলা হলেন স্বয়ং শিব।”
“তিনি কি এ-গাঁয়ে আসেন?”
“প্রায়ই আসেন। এই তো সেদিন আমার কেলে গোরটার কলেরার মতো হল। গবা পাগলটাকে ডেকে আনতে তিনি এসে এমন এক ভস্ম খাইয়ে দিলেন যে, পরদিন থেকে গোবর একেবারে ইটের মতো এঁটে গেল।”
এই পর্যন্ত শুনে গোবিন্দ বাড়িতে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু মুশকিল হল, এ-লোকটা পুলিশের লোক নয়। লম্বা এবং বিশাল চেহারার এই দানবকে গোবিন্দ চেনে। রয়্যাল সারকাসে লোকটা পাঁচ মন ভার তুলে রোজ লোককে তাক লাগিয়ে দিত। তারপর সে হঠাৎ একদিন সারকাস ছেড়ে উধাও হয়। গোবিন্দ কানা ঘুষো শুনেছে, এই লোকটা অর্থাৎ সাতনা একটা বাজে সঙ্গে পড়ে খুন-কারাপি করে বেড়ায়। কেন সাতনা খারাপ লোকদের দলে ভিড়ল তাও খানিকটা জানে গোবিন্দ। সাতনার সাত বছর বয়সের একটা মা-মরা মেয়ে ছিল। কে বা কারা সেই মেয়েটাকে চুরি করে সারকাস থেকে নিয়ে যায়, তারপর দশ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। সাতনার অত টাকা ছিল না। আদরের মেয়েকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য সে রয়্যাল সারকাসের মালিকের হাতে পায়ে ধরে টাকাটা ধার হিসেবে চায়। কিন্তু সারকাসের মালিক টাকাটা দেয়নি। কিছুদিন পর কে মেয়েটিকে নাকি কাশীতে ভিক্ষে করতে দেখেছিল। তখন তার জিব কাটা, একটা চোখ কানা। সানা কাশীতে যায়, কিন্তু মেয়েকে পায়নি। সেই থেকে পাগলের মতো হয়ে যায়। কাশিমের চরের কাছে সুলতানপুরের মেয়েটি চুরি যায়। সাতনা নিজের সঙ্গে মেয়েটাকে নিয়ে সারকাসের দলে ঘুরে বেড়াত। মেয়েকে খেলা শেখাত। সেই মেয়ে নিখোঁজ হওয়ায় সে আবার সুলতানপুরে ফিরে আসে। তারপর কী হয়েছে তা আর গোবিন্দ স্পষ্ট জানে না।
এখন সাতনা তার খোঁজ করছে জেনে সে খুব অবাক হল। সাতনার সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই। অবশ্য বন্ধুত্বও নেই। সাতনার সঙ্গে খুব সামান্য একটু চেনাজানা মাত্র ছিল তার।
রাতে খড়ের গাদায় শুয়ে অনেক ভেবেও সে কিছুতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। তবে সাতনার সঙ্গে হরিহর পাড়ুইয়ের খুব বন্ধুত্ব ছিল একসময়ে। হরিহর ছিল সুলতানপুরের সুলতান। তার কথায় গোটা গঞ্জ উঠত বসত। কিন্তু সেটা করত ভয়ে। ঐ রকম ভয়ংকর লোক দুটো দেখা যায় না।
গোবিন্দ ঘুমিয়ে পড়েছিল, মাঝরাতে আচমকা ধোঁয়ার গন্ধে উঠে বসল। চোখ কচলে চেয়ে কিছু বুঝবার আগেই হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল পুরো খড়ের গাদাটার চারপাশে দিয়ে বেড়াজালের মতো আগুনের শিখা উঠে আসছে। ভাল করে ব্যাপারটা বুঝবার আগেই আগুনের শিখা দাপিয়ে উঠল আকাশে।
চারদিকে রক্তাভ লেলিহান ভয়ংকর আগুন। গেরবাড়ি থেকে বিকট চেঁচামেচি আসছিল। লোকজন দৌড়ে আসছে।
গোবিন্দ কী করবে বুঝতে পারছিল না। চারদিক দিয়ে আগুন যে ভাবে ঘিরে ধরেছে তাতে পালানোরা কোনো স্বাভাবিক পথ নেই। কিন্তু আর কয়েক
সেকেণ্ডে থাকলেও আগুনে বেগুন-পোড়া হতে হবে।
গোবিন্দ উঠল। পায়ের নীচে নরম ঘড়। তার জন্য শরীরের ভারসাম্য রাখাই দায়। লাফ দেওয়ার জন্য পায়ের নীচে শক্ত মাটি দরকার।
গোবিন্দ কিছু না-ভেবেই মাথার ওপর থেকে টেনে এক পাঁজা খড় সরিয়ে ফেলল। মাঝখানের শক্ত খুঁটিটা দেখতে পেয়ে কাঠবেড়ালির মতো সেটা বেয়ে উঠে এল একদম ওপরে। খুঁটিটার মাথায় দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কোনক্রমে পায়ের পাতা রাখা যায় মাত্র। কিন্তু সারকাসের খেলোয়াড়ের কাছে তা যথেষ্ট।