উদ্ধববাবু বিস্তর মামলা-মোকদ্দমা করেছেন। তিনি জানেন, যার কাছে কোনো গোপন খবর থাকে, তার জীবন সর্বদাই বিপদসংকুল। এই পাখিটা নিশ্চিত লুকোনো সম্পদের খবর জানে। এ পর্যন্ত পাখিটার ওপর হামলাও কিছু কম হয়নি। কিন্তু এতকাল কাকাতুয়াটা কাশিমের চরের কথা বলেনি। কেউ যদি কথাটা শুনতে পায়, তবে যেমন করেই হোক হন্যে হয়ে পাখিটাকে হাত করার চেষ্টা করবে। তার জন্য খুন পর্যন্ত করতে পিছপা হবে না।
উদ্ধববাবু আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বিছানায় গা ঢালতেই পিঠের নীচে কী একটা খচমচ করে উঠল। উঠে দেখলেন একটা খাম তাতে ভঁর নাম লেখা।
খাম খুলতেই একটা চিঠি।
মহাশয়, কাকাতুয়াটিকে ফেরত পাইবার জন্য যে প্রস্তাব দিয়াছিলাম তাহা আপনি কার্যত অগ্রাহ্য করিয়াছেন। বুঝিতেছি সহজ পথে আপনি পাখিটিকে ফেরত দেবেন না। তাহাতে অবশ্য আমাদের কিছুই না, বিপদ আপনারই। আজ আদালতের বাহিরে যা ঘটিল, তাহা একটি নমুনা মাত্র। বোমাটিতে কেবল আওয়াজের মশলা ছিল, ক্ষতিকারক কোনোকিছু ছিল না। আপনাকে আমাদের সম্পর্কে সচেতন করিয়া দিতেই এই কাজ করিতে বাধ্য হইলাম। ইহার পর যদি কখনো আমাদের বোমা প্রয়োগ করিতে হয়, তবে এবার তাহার মধ্যে মারাত্মক বস্তু সকলই থাকিবে। মনুষ্যজীবন অতীব মহার্ঘ বিবেচনা করিয়া ভালয়-ভালয় পাখিটিকে আমাদের হতে তুলিয়া দিবেন। বেশি কিছু করিতে হইবে না। আপনাদের বাহিরের বারান্দায় আজ রাতে পাখির দাঁড়টা (পাখি সমেত) ঝুলাইয়া রাখিবেন। কোনো পাহারা রাখিবেন না আমরা যথাসময়ে তাহা হস্তগত করিব। ক্ষতিপূরণ বাবদ যথেষ্ট অর্থও আপনি পাইবেন। ইতি।
এর আগের চিঠিতে ‘আমি আমি’ করে লেখা ছিল। এই চিঠিতে বহুবচনের ‘আমরা।
উদ্ধববাবু চারদিকে চেয়ে দেখলেন শোওয়ার ঘরের তিন দিকেই বড় বড় জানালা। দক্ষিণ দিকে বাগান, পূর্বদিকেও বাগান, উত্তরদিকে কলতলা। পত্রবাহক কোন দিক দিয়ে এসে টুক করে এই অল্প সময়ের মধ্যে জানালা গলিয়ে বিছানায় চিঠিটা ফেলে গেছে, তা অনুমান করা শক্ত। তবে এরা যে বেশ সংগঠিত দল তাতে সন্দেহ নেই।
উদ্ধববাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “হুঁ।” পাখিটাও তার হু শিখে গেছে। সেও বলল, “হুঁ।”
উদ্ধববাবু কাকাতুয়ার দিকে চেয়ে দেখলেন পাখিটাও তার দিকেই চেয়ে আছে। বড় মায়া পড়ে গেছে উদ্ধববাবুর। উঠে গিয়ে কাকাতুয়ার পালকে হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন “কেন যে বাবা গোপন কথাগুলো শিখতে গেলি। এখন তোরও বিপদ, আমারও বিপদ।”
পাখিটা হঠাৎ আর্তস্বরে বলে উঠল, “বিশু, আমাকে মেরো না! মেয়র।”
উদ্ধববাবু চমকে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। না, কেউ কোথাও নেই। পাখিটা পুরনো মুখস্থ বুলিটা বলছে।
আলমারি খুলে উদ্ধববাবু তার বাবার আমলের দোনলা বন্দুকটা বের করলেন। বহুকাল কেউ বন্দুকটা চালায়নি। উদ্ধববাবু বন্দুকটা পরিষ্কার করতে বসে গেলেন।
ভয়ের চেয়ে ভালবাসা অনেক বড়। উদ্ধববাবু ভয়ের কাছ হার নামতে রাজি নন।
.
১৫.
এমনিতে দেখতে গেলে মাস্টার গোবিন্দ বেশ সুখেই আছে। সারাটা দিন গোরু চরান, গেরস্ত বাড়ির অজস্র কাজ মুখ বুজে করে, পেট ভরে খায় আর সন্ধের পর খড়ের গাদায় ঢুকে ঘুমোয়। বোবা কালা হয়ে থাকতে একটু কষ্ট হয় বটে, কিন্তু সেটা সইয়ে নিচ্ছে।
মাঝে-মাঝে বেমক্কা মুখ ফুটে এক-আধটা শব্দ বেরিয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু ততটা ক্ষতি কিছু হয়নি।
সেদিন গেরস্তর ছেলের বউ এক গামলা ফুটন্ত ভাতের ফ্যান উঠোনের কোণে রেখে খার কাঁচতে গেছে, এমন সময় গেরস্তর ছোট্ট নাতি হামা টানতে টানতে গিয়ে সেই গামলার কান ধরে উঠতে গিয়েছে। গোবিন্দ গোরুগুলোকে মাঠ থেকে নিয়ে আসতে যাচ্ছিল দুপুর বেলা। এই দৃশ্য দেখে বেখেয়ালে ‘ইশ, গেল, ছেলেটা গেল’ বলে চেঁচিয়ে দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। ভাগ্যিস কেউ শোনেনি।
আর একদিন গেরস্তর মেজো ছেলে সকালে তাকে ঘুম থেকে তুলে দিতে এসেছিল। তখন একেবারে কাকভোর। আগের রাত্রে যাত্রা শুনেছে বলে ঘুমটা ভোরে খুব গাঢ় হয়েছিল গোবিন্দর। ছেলেটার ডাকাডাকিতে উঠে বসে বলে ফেলেছিল “দুত্তোর, এমন ষাড়ের মতো কেন চেঁচায় লোকে!” ছেলেটা অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, “এ কী! তুমি যে বড় কথা বলতে পারো।” গোবিন্দ ফ্যাসাদে পড়ে অনেকক্ষণ বুবু করল বটে, কিন্তু ছেলেটার যেন প্রত্যয় হল না। পাছে লোক জানাজানি হয়ে যায়, সেই ভয়ে তখন। ছেলেটাকে কিছু-কিছু কথা খুলে বলল গোবিন্দ। রাজি করাল যাতে কাউকে বলে।
বেশ কাটছিল। কিন্তু একদিন সকালবেলা গোবিন্দ দেখল, একাট রোগা খুঁটকো মতো তোক গেরস্তর সঙ্গে উঠোনে বসে কথা বলছে লোকটার চাউনি টাউনিগুলো ভাল নয়। কথা বলতে-বলতে চারদিকে নজর রাখছে। বোঝ যায় কিছু বা কাউকে খুঁজছে।
লোকটা চলে যাওয়ার পর গোবিন্দ গেরস্তর মেজো ছেলেকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “যে লোকটা এসেছিল সে কে বলো তো!”
“ও হল ফন্তুবাবু।”
“সে আবার কে?”
“দালালি-ফালালি করে। জমি বেচাকেনার কারবার আছে।”
“আর কিছু?”
“আর কিছু তো জানি না।”
“মানুষটা কেমন?”
“তা কে জানে! তবে বাবার কাছে মাঝে-মাঝে আসে।”
“আজ কেন এসেছিল একটু খোঁজ নেবে? যাও, তোমার বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো।”
ছেলেটা একটু বাদে ঘুরে এসে বলল, “কে একটা লোক জেলখানা থেকে পালিয়ে এদিকে এসেছে তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল।