গবা জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছিস রে?”
লোকটা ‘ব ব ওয়াঁ’ গোছের কিছু দুর্বোধ শব্দ করল।
গবা মাথা নেড়ে বলে “বেশ বেশ বেশ। তুই তো আবার কানেও শুনিস। তবু বলি, এরা ভাল লোক। এদের কাছে ভাল হয়ে থাকবি। চল, একটু এগিয়ে দিবি আমাদের। আঁধার হয়ে এসেছে, লণ্ঠনটা নিয়ে সঙ্গে আয়।”
শুনে গেরস্তর ছেলেপুলেরা হৈ হৈ করে উঠল। এখুনি যাবে কী গবা জ্যাঠা। আমরা যে তোমার সেই মেছো-ভুতের গল্পটার শেষটুকু শুনব বলে কতদিন ধরে হা-পিত্যেশ করছি. সেই যে গো আন্নাপুরের বড় ঝিলে সেবার মাছ ধরতে গিয়ে জলে একটা বড় কড়াই ভাসতে দেখিছিলে। তারপর সেই ভাসন্ত কড়াইটা যেই কাছে এসেছে অমনি সেটাকে ধরতে গিয়ে হাতে গরম ছ্যাকা খেলে! তারপর দেখলে, কড়াইটা জলে ভাসছে বটে কিন্তু তাতে গরম তেল ফুটছে। তারপর কী হল?”
গবা উঠে পড়ে বলল, “সে আর একদিন হবে। বাবুর বাড়ির ছেলেকে নিয়ে এসেছি, তাড়াতাড়ি না ফিরলে রক্ষে থাকবে না।”
রাখালটা লণ্ঠন আর লাঠি হাতে তাদের সঙ্গে এগিয়ে দিতে এল। মেঠোপথে পা দিয়েই বোবা রাখাল কথা কয়ে উঠল, “গবাদা, ওদিকে কী হচ্ছে?”
“ধুন্ধুমার। পুলিস চারদিকে তোমায় খুঁজছে।”
.
১৪.
একটা শক্ত মামলায় মক্কেলকে জিতিয়ে দিয়েছেন উদ্ধববাবু। বড়লোক মক্কেল সকালেই বিরাট ভেট নিয়ে হাজির। ফলের ঝুড়ি, মিষ্টির চ্যাঙারি, দৈয়ের হাঁড়ি, বারকোষে মস্ত রুইমাছ,
ধামাভর্তি শীতের সজি। এলাহি কাণ্ড।
মামলায় জিতে উদ্ধববাবুর মনটা আজ ভাল। অন্য একটা মামলায় সওয়ালের ফাঁকে গুনগুন করে ভৈরবী ভেঁজে নিচ্ছিলেন। আদালতে গান গাওয়া নিষিদ্ধ। হাকিমসাহেব গুনগুননি শুনে বারবার এধার-ওধার তাকান, কিন্তু কোত্থেকে গানটা আসছে তা বুঝতে পারেন না। বার দুই তিন হাতুড়ি ঠুকে “অর্ডার অর্ডার” হাঁক দিলেন। প্রতিবারই উদ্ধববাবু রুমালে মুখ ঢেকে জিব কাটলেন। কিন্তু গান জিনিসটা ভারী অবাধ্য। ভিতরে গানের ফোয়ারা খুলে গেলে তাকে ঠেকায় কার সাধ্য।
অবশেষে বিপক্ষের উকিল উঠে হাকিমকে বললেন, “আমাদের লার্নেড ফ্রেণ্ড উদ্ধববাবুর স্বভাব অনেকটা কোকিলের মতো। বসন্ত সমাসঃ দেখে ওঁর কণ্ঠ কুহু কুহু’ রবে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কোকিল যেমন কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, উনিও তেমনি ওঁর গানের ডিম এই আদালতে পেড়ে রেখে যাচ্ছেন।”
এই অদ্ভুত সওয়ালে হাকিম ভূ কোচকালেন, লজ্জিত উদ্ধববাবু ঘাড় চুলকোচ্ছেন। আর-এক হাতুড়ি মেরে আদালতকে চুপ করিয়ে উদ্ধববাবুকে বলেন, “আপনার হিয়ারিংয়ের জন্য একটা ডেট নিন। আজ বাড়ি চলে যান।”
হাঁফ ছেড়ে উদ্ধববাবু বেরিয়ে এলেন। বাস্তবিক এতক্ষণ তার হাঁফ ধরে আসছিল, আইঢাই করছিল। পাকা ফোঁড়ার মতো ভিতরে টনটন করছে গান। একটু টুশকি দিলেই বোমার মতো ফেটে পড়বে। সেই টুশকিটা এতক্ষণ দিতে পারছিলেন না।
এজলাসের চৌহদ্দি পার হয়ে রাস্তায় পড়েই গানের ফেঁড়াটায় টুশকি দিলেন উদ্ধববাবু। আর বাস্তবিক সেটা বোমার মতোই ফাটল। হাঁ করে প্রথম তানটা লাগাতেই এত জোর শব্দ হল যে, উদ্ধববাবু নিজেই হকচকিয়ে গেলেন।
শুধু তাই নয়। সেই শব্দে রাস্তার লোকজনও পালাতে লাগল। কাক কা-কা করে উড়ে উড়ে ঘুরতে লাগল। উদ্ধববাবু তাজ্জব হয়ে দেখলেন, তাঁর গানের কোঁড়াটা বোমার মতো ফেটে চারদিকে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে।
ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কেটে যেতে কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল। তারপর উদ্ধববাবু হঠাৎ বুঝতে পারলেন শব্দটা তার গলা থেকে বেরোয়নি। অমন বোমার মতো আওয়াজ খুব বড় ওস্তাদের গলা থেকে বেরোবার কথা নয়। যুক্তি অনুসরণ করলে সন্দেহ থাকে না, বোমার মতো আওয়াজটা একটা বোমারই কাজ। আর সেটা ফেটেছে উদ্ধববাবুর মাত্র হাত দশেকের মধ্যে।
রাস্তার আর-পাঁচজনের মতো উদ্ধববাবুও দৌড়তে লাগলেন। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার সময় নেই। গলায় গানটাও আর ঠেলাঠেলি করছে না।
বাড়িতে এসে নিজের ঘরে শুয়ে চোখ বুজে অনেকক্ষণ হাঁফ ছাড়লেন উদ্ধববাবু। ব্যাপারটা কী হল তা বুঝতে পারছিলেন না। বোমাটা এত কাছাকাছি ফেটেছে যে, সেই শব্দে তার মাথাটা এখনও ডোম্বল হয়ে আছে। এমন কী শুয়ে-শুয়ে কয়েকবার ভৈরবীতে তান লাগানোর চেষ্টাও করলেন উদ্ধববাবু। কিন্তু গলার স্বর ফুটল না।
ভিতরের বারান্দা থেকে কাকাতুয়াটা বলে উঠল “দাঁড়া, তোকে মজা দেখাচ্ছি। দাঁড়া, তোকে মজা দেখাচ্ছি।”
উদ্ধববাবু কাকাতুয়ার কথা শুনে উঠে বসলেন। মক্কেল যে অঢেল ভেট দিয়ে গেছে, তা ফেলে-ছড়িয়ে খেয়েও শেষ হওয়ার কথা নয়। তাই উঠে ভিতরবাড়ি থেকে একটা রসগোল্লার হাঁড়ি এনে কাকাতুয়াটাকে খাওয়াতে লেগে গেলেন।
কাকাতুয়াটা বেশ চেখে-চুখেই খাচ্ছিল। কয়দিনে পাখিটা উদ্ধববাবুকে খুব চিনেছে। খেতে-খেতে ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে উদ্ধববাবুকে দেখছিল। হঠাৎ একটু চাপা গলায় বলল, “কাউকে বোলো না। কাশিমের চরে অনেক মোহর আছে।”
উদ্ধববাবু হাঁ করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “বলিস কী রে?”
“বিশু জানে না। বিশু জানে না।”
“বিশুটা কে বলবি তো।”
পাখি তখন অন্য কথা বলতে লাগল, “রামু, তুমি ভীষণ দুষ্টু। পড়তে যাও। নইলে গোস্লা পাবে।” তারপর আবার স্বর পালটে বলে, “দাঁড়া, তোকে মজা দেখাচ্ছি।”
চারদিকে চেয়ে উদ্ধববাবু পাখির দাঁড়টা বারান্দা থেকে নিজের ঘরে এনে রাখলেন।