“তুমি বেঁচে গেলে বুঝি!”
“আরে দূর! অত সহজ নাকি? লোকগুলো টর্চ জ্বেলে দৃশ্যটা দেখেই চেঁচিয়ে বলে উঠল, এখনো বেঁচে আছে! সর্বনাশ। শেষ করে দে। শেষ করে দে। বলতে বলতে একাট লোক মঙ দা বের করে প্রথম কোপটায় হরিহরের গলা নামিয়ে দিল।”
“বলো কী? আর তুমি?”
“আর যারা ছিল তারা বলল, এ লোকটা কে রে? আর একজন বলল, যেই হোক, সাক্ষী রেখে লাভ নেই। লোকটা বেঁচে আছে। গলাটা নামিয়ে দে। সঙ্গে-সঙ্গে আর একটা লোক ঘচাত করে আমার গলাটাও নামিয়ে দিল।”
“যাঃ, কী যে বলো!”
“যা বলছি শুনে যাও। একেবারে প্রত্যক্ষ ঘটনা, দুনিয়ার আর কোনো মানুষের এমন অভিজ্ঞতা নেই। স্পষ্ট নিজের কাটামুণ্ডু প্রত্যক্ষ করলাম। বুঝলে! গলা দিয়ে ফোয়ারার মতো রক্ত পড়ছে। ধড়টা একটু ছটফট করছে। কিন্তু মুখোনা দিব্যি হাসি-হাসি।”
“গুল মারছ গবাদা।”
“সত্যি না। তারপর হল কী শোনো। সে এক কাণ্ড।”
“বলো।”
“ওরা তো আমাদের বন্ধ করে রেখে পালিয়ে গলে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটা গাছে ঠেস দিয়ে বসলাম। বারবার গলায় হাত বোলাচ্ছি। কিন্তু সেটা তো আমার গলা নয়। শরীরটা তখন বাতাসের মতো হালকা পাতলা জিনিস হয়ে গেছে। দেখি ঝোঁপের ওপাশ থেকে হরিহর পাড়ুইও উঠে পড়ে চারদিকে কটমট করে চাইছে। তার চাউনি দেখে ভয় খেয়ে পালাতে গিয়ে মনে হল, এখন আর ওকে ভয় কী? আমিও একটু ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। হরিহর আমাকে পছন্দ করছিল না। কাছে যেতেই একটা হুংকার দিল, খবরদার! আমি খিক করে হেসে বললাম, তোমার আর সেই দিন নেই হে হরিহর। মাথা গরম কোরো না বাবা। তার চেয়ে চলো চাঁদের আলোয় চরে বেড়াতে-বেড়াতে দুটো সুখদুঃখের কথা কই। হরিহর প্রথমটায় একটু গোঁ ধরে বসে ছিল। তারপর যখন সত্যিই বুঝল যে, সে মরে গেছে, তখন আমার সঙ্গে মিশতে আপত্তি করল না তেমন।”
“মরে গিয়ে তুমি ফের বেঁচে উঠলে কী করে?”
“সে তো আর-এক গল্প। আলফা সেনটরির গ্রহ থেকে যাদের আসবার কথা ছিল, তারা ভোর-রাত্রে এসে আমার দশা দেখে চটপট মাথাটা জুড়ে দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলল যে।”
“যত সব গুল। কিন্তু পাখি কী জানে তোত বললে না?”
হাঁ। সেইটেই তো আসল গল্প। আর একদিন হবে’খন।”
.
১৩.
রামু সঙ্গে-সঙ্গে গবার হাত ধরে বলে, “না, না, বলো। বলতেই হবে।”
গবা মাথা চুলকে বলে, “আসলে কী জানো, বেশ কিছুদিন আগেকার কথা কিনা, ঠিক স্মরণ হচ্ছে না। তার ওপর আমার মাথাটা কাটা গিয়েছিল তে, তাতেও বুদ্ধি একটু ঘুলিয়ে গেছে। জ্যোৎস্নায় কাশিমের চরে হরিহরের প্রেতাত্মার সঙ্গে আমার যে-সব কথা হয়েছিল তার মধ্যে পাখির কথাটা আসেনি। মনে আছে আমরা সেই গলা কাটনেওলা লোকগুলোর আক্কেল নিয়ে কথা বলছিলাম। হরিহর একবার ভুল করে একটা মশা মারতে গিয়েছিল তাও মনে আছে। হাওয়া হাত দিয়ে কি আর মশা মারা যায়? দুজনে খুব হেসেছিলাম। কী হয় জানো, মরলে পর আর পুরনো শত্রু, রাগ, হিংসা এ-সব থাকে না। বেঁচে থেকে মানুষ যে-কাণ্ডমাণ্ড করে সেগুলোকে ভারী ছেলেমানুষি মনে হয় তখন। বাঁচা অবস্থায় তো আমি হরিহরকে কতই না সমঝে চলছিলাম, মরার পর আবার সেই হরিহরের সঙ্গেই চাঁদের আলোয় গলা-ধরাধরি করে বালির ওপর কত ঘুরলাম।”
“পাখির কথাটা তুললে না?”
“ঐ যে বললাম, বাঁচা অবস্থায় কৌতূহলগুলো পর্যন্ত মরার সঙ্গে সঙ্গে মরে যায়।”
“পাখিটা তবে কি জানত?”
“সেটা ভেবে দেখতে হবে!”
“আর হরিহরকে সেদিন খুনই বা করল কারা? তাদের তুমি চেনো?”
“কস্মিনকালে না।”
“মাস্টার গোবিন্দকে তাহলে পুলিস ধরল কেন?”
“এমনি-এমনি ধরেনি। গোবিন্দরও দোষ আছে।”
“কী দোষ?” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গবা বলে, “সে আবার আর-এক গল্প।”
“তাহলে গল্পটা বলে ফেল।”
“সেটা একদিন গোবিন্দর কাছেই শুনে নিও। আজ মেলা বকবক করে ফেলেছি।”
“গোবিন্দর কাছে কবে আমাকে নিয়ে যাবে?”
“আমি এখন তার কাছেই যাচ্ছি। ইচ্ছে করলে তুমিও যেতে পারো। তবে খবর্দার, ঘুণাক্ষরেও কাউকে বোলো না যেন। জানাজানি হলেই পুলিস গবাকে ধরে নিয়ে গারদে পুরবে।”
শহর ছাড়িয়ে মাইলটাক মেঠোপথে হাঁটলে একটা বেশ সমৃদ্ধ গাঁ। সন্ধ্যের একটু আগে সেই গাঁয়ের এক সম্পন্ন গেরস্তবাড়িতে রামুকে নিয়ে হানা দিল গবা।
গবাকে দেখে বাড়ির সবাই তটস্থ। “আসুন, আসুন, বসতে আজ্ঞা হোক।”
নিকোনো উঠোনে জলচৌকি পেতে দেওয়া হল। ঘটির জলে হাতমুখ ধুয়ে এসে রামু আর গবা পাশাপাশি দুটো জলচৌকিতে বসতে না বসতেই দুটো ছোটো ধামায় টাটকা ভাজা মুড়ি, বাতাসা, নারকেল আর দুধ খেতে দেওয়া হল তাদের। সারা দিনে রামুর এই প্রথম সত্যিকারের কিছু খাওয়া। সে যখন হালুম-হুঁলুম করে খাচ্ছে তখন গবা খুব মুরব্রি চালে গেরস্তকে জিজ্ঞেস করল, “গরু রাখার জন্য যে বোবা কালা লোকটাকে দিয়েছিলাম সে কেমন কাজ-টাজ করছে?”
“আজ্ঞে কাজ ভালই করে। খায়ও কম। কিন্তু লোকটা ভারী রাগী।”
“খুব চোটপাট করে বুঝি?”
“গেরস্থ একটু অবাক হয়ে বলে, “বোবা লোক চোটপাট করবে কেমন করে? তা নয়, তবে চোখ দুখান দিয়ে মাঝে মাঝে এমনভাবে তাকায় যে, পেটের মধ্যে গুড়গুড়নি উঠে যায়।”
“ লোকটা কোথায়?”
“একটু আগে গোরু নিয়ে ফিরল। এখন গোয়ালে সাঁজাল দিচ্ছে। ডাকাচ্ছি।”
গেরস্তর ছেলে গিয়ে রাখালটাকে ডেকে আনল। পরনে আধময়লা হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা মোটা কাপড়ের পিরান, গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটির দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যে, তাকালে বুকের মধ্যে একটু ধুকুর পুকুর হয় বটে।