কিন্তু গবা কোথাকার স্পাই কার স্পাই তা কুন্দকুসুম ঠিক জানেন না। এর আগেও তিনি গবাকে ধরে এনে বিস্তর জেরা করেছেন, খোঁজ-খবর নিয়েছেন, কোনো তথ্য আবিষ্কার করতে পারেননি। তার্তে তাঁর সন্দেহটা আরো ঘোরতর হয়েছে।
“এই যে গবাঠাকুর”–বলে একপাল পেঁয়ো মেয়ে-পুরুষ রাস্তার মাঝখানেই ঢিবঢিব করে গবা পাগলাকে প্রণাম করল। তারা সব হাটবারে আনাজপাতি, ধামাকুলো, গোরু ছাগল, মুর্গি ডিম, ধান চাল, দড়িদড়া নিয়ে বেচতে যাচ্ছে শহরে। তাদের ধারণা, গবাঠাকুর আকাশে উড়তে পারে, অদৃশ্য হতে পারে, জলের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে, যে-কোন রোগ হাতের ছোঁয়ায় সারিয়ে দিতে পারে।
গবা তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “হবে হবে, সব হবে, একবার যদি ছুঁচে সুতোটা পরাতে পারি। দেখিস খন, সব অকাল চলে যাবে, ক্ষেতে-ক্ষেতে ধান আর ধরবে না, পুকুরে নদীতে মাছের গাদি লেগে যাবে। দাঁড়া একবার, ছুঁচে সুতোটা পুরাই………”
বাঘা ওস্তাদা গাইয়ে রাঘব ঘোষ সকালের দিকেটায় গলা সাধছিলেন। রোজই সাধেন। ভারী দাপুটে গলা। সাতটা সুর একেবারে রামধনুর মতো তার গলায় লেগে থাকে।
ঘণ্টা তিনেক গলার কসরত করায় এই শীতকালেও বেশ ঘেমে গেছেন রাঘব ঘোষ। একটু জিরিয়ে জর্দাপান মুখে দিয়ে তানপুরাটা সবে তারায় জড়িয়ে ধরে পিড়িং করেছেন মাত্র, অমনি মূর্তিমান গবা ঘরে ঢুকে বলল, “আরে সা লাগাও! সা লাগাও। একবার যদি ঠিকমতো ‘সা’-টা লাগাতে পারো, তাহলেই হয়ে গেল, সুরে জগৎ ভেসে যাবে। ‘সা’ লাগালে ‘রে’ আসবে মা রে বাবা রে বলে তেড়ে। রে এলে কি আর ‘গা’ দূরে থাকবে গা? এসে যাবে গা দোলাতে-দোলাতে। ‘গা’ যদি এল তবে ‘মা’-এর জন্য আর ভাবনা কী গো? মা তো মায়ের মতো কোল পেতেই আছে। আর মা এর পা ধরেই সেধে আসবে ‘পা’! পা-এর পিছু পিছু ধেয়ে আসবে ‘ধা’। ধাঁ ধাঁ করেই আসবে হে। আর কী বাকি থাকে? ‘নি’? নির্ঝঞ্ঝাটে আসবে, নির্ঝঞ্ঝাটে আসবে। নিত্যি নিত্যি আসবে, নৃত্য করতে করতে আসবে। এইভাবেই পৌঁছে যাবে তার গ্রাম। ধরো ফের চড়ায় গিয়ে ‘সা’-এর চুলের মুঠি। বুঝলে? সা লাগাও হে, ঠিকমতো সা লাগাও।”
রাঘব ঘোষ বুঝলেন না। তবে মাথা নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গবা এল, জীবনে আর শান্তি রইল না।
তবে গবা আসায় শহরে যে একটা শোরগোল পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
উদ্ধববাবু ভারী রাসভারী লোক। তার সারা জীবনটাই রুটিনে বাঁধা।
তেমনি রুটিনে বাঁধা তার তিন ছেলে আর তিনমেয়ের চলা-ফেরা, লেখাপড়া, খেলাধূলো। তার গিন্নিও রুটিন মেনে চলেন। চাকরবাকর ঝি তো বটেই, তার বাড়ির গোরু ছাগল কুকুর বেড়াল পর্যন্ত কেউই রুটিনের বাইরে পা দেয় না। উদ্ধববাবু বলেন, ডিসিপ্লিন ইজ দি এসেন্স অব সাকসেস।
মুসকিল হল মাসখানেক আগে তিনি একটা ভালজাতের কাকাতুয়া কিনেছেন। তার ইচ্ছে ছিল, তাকাতুয়াটাকে শিখিয়ে পড়িয়ে এমন তৈরি করবেন যাতে সেটা তাঁর গবেট ছোট ছেলে রামুটাকে উঠতে-বসতে ডিসিপ্লিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। উদ্ধববাবুর ছোট ছেলেটাই হয়েছে সবেচেয়ে সৃষ্টিছাড়া। শাসনে থাকে, দুষ্টুমিও বেশি করতে পারে না বটে, কিন্তু সে এই বাড়ির আবহাওয়া ঠিক মেনেও চলে না। আকাশে রামধনু উঠলে রামু হয়তো বাইরে গিয়ে দুহাত তুলে খানিক নেচে আসে। ঘুড়ি কাটা গেল দৌড়ে যায় ধরতে। অঙ্কের খাতায় একদিন লিখে রেখেছিল, “কে যায় রে ভোগাড়িতে উড়িয়ে ধূলো? যা না ব্যাটা……. দেখে শিউরে উঠেছিলেন উদ্ধববাবু। ঐটুকু ছেলে কবিতা লিখবে কী? কিন্তু কতই বা আর একটা ছেলের পিছনে লেগে থাকবেন তিনি? তার তো কাজকর্ম আছে! মস্ত উকিল, দারুণ নামডাক, ব্যস্ত মানুষ। তাই ঠিক করেছিলেন, কাকাতুয়াটাকে রামুর পিছনে লাগিয়ে দেবেন। সে বলবে, “রামু পড়তে বোসো। রামু এবার স্নান করতে যাও। রামু, আজ আধ ঘন্টা বেশী খেলেছ।রামুরামধনু দেখতে যেওনা।রামু, কাটাঘুড়ি ধরতে নেই…….ইত্যাদি।
কিন্তু মুশকিল হল, কাকাতুয়াটা প্রথম দিনই নিজে থেকে বলে উঠল, “আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। বিশু বাতিটা নিভিয়ে দাও। ওঃ, কী মশা! কী মশা!”
ধৈর্য ধরে উদ্ধববাবু পরদিন তাকে আবার রামু-শাসন শেখাতে বসলেন। কাকাতুয়াটা গম্ভীরভাবে শুনল। তারপর বলল, “বিশু, আমার খাবারে খুব ঝাল দিও।” উদ্ধববাবু কটমট করে পাখির দিকে চেয়ে বললেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে?” কাকাতুয়াটা এ-কথায় খক-খক করে হেসে বলল, “আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। খকখক।”
উদ্ধববাবু পরদিন আবার পাখিকে পড়াতে বসালেন। পাখি তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেকক্ষণ লক্ষ্য করে বলল, “বালিশের তলায় কী খুঁজছ বিশু? আলমারির চাবি?”
উদ্ধববাবু বললেন, “আহা, বলো, রামু এখন ঘুম থেকে ওঠো।”
পাখি বলল, “বিশু, আমার ঘুম পাচ্ছে। আলমারিতে টাকা নেই। অন্য জায়গায় আছে।”
উদ্ধববাবু বললেন, “হোপলেস।”
.
০২.
কাকাতুয়াকে শেখাতে গিয়ে উদ্ধববাবু ঘেমে ওঠেন। রেগে গিয়ে চেঁচাতে থাকেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে? অ্যাঁ! ইয়ার্কি?” কাকাতুয়াটা একথাটা খুব টক করে শিখে নেয়। ঘাড় কাত
করে উদ্ধববাবুর দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “ইয়ার্কি হচ্ছে? অ্যাঁ! ইয়ার্কি?”
“নাঃ তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। টাকাটাই জলে গেল দেখছি।” উদ্ধববাবু হতাশভাবে এই কথা বলে উঠে পড়লেন। নেয়ে খেয়ে আদালতে যেতে হবে।