“লোকটা কী করল?”
“লোকটা তখন পালাচ্ছিল। খুব অদ্ভুত দৃশ্য। হরিহর পাড়ুইকে পালাতে দেখাটাও ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ সাধারণত তাকে দেখেই অন্যেরা পালায়। তাই তাকে পালাতে দেখে ভারী অবাক লাগল। কাশিমের চরে এমনিতে ঘরবাড়ি নেই, তবে বহুকাল আগেরকার একটা ভাঙা বাড়ি আছে, সাপখোপ শেয়াল তক্ষক বাদুড় আর পাচার আচ্ছা। চোরে-ডাকাতেও বড় একটা কেউ সেই বাড়িতে ঢোকে না। আমি যেখানে বসেছিলাম, সেখান থেকে একটু ডাইনে কোনাকুনি একটা ঝাউবন। তার আড়াল থেকে সেই ভাঙা বাড়িটার একটা গম্বুজ দেখা যাচ্ছিল। নিকষ্যি অন্ধকার। হরিহর পাড়ুই কোলকুঁজো হয়ে সেই ঝাউবনের মধ্যে ঢুকে বাড়িটার দিকে যাচ্ছে বলে মনে হল। এমন সময়ে দেখি, গম্বুজে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। কে যেন উঁচু থেকে একটা টর্চবাতি জ্বালছে আর নেভাচ্ছে। আমার মনে হল, ব্যাপারটা একটু দেখা দরকার।”
“তোমার ভয় কর না?”
“না, ভয়ের কী? দুনিয়াটাই তো নানা খারাপ জিনিসে ভরা। ভয় পেতে শুরু করলে তার আর শেষ নেই।”
“তুমি কী করলে?”
“উঠে হরিহরের পিছু পিছু এগোতে লাগলাম। সেটাও দুঃসাহসের কাজ। হরিহর যদি টের পায় তাহলে চোখের পলকে আমার ঘাড় থেকে মাথা নামিয়ে দেবে কসাই-ছুরি দিয়ে। তার কাছে সব সময় অস্ত্রশস্ত্র থাকে। স্বভাবটাও কেমন পাগলা খুনির। তাই খুব ঠাহর করে দেখে-শুনে সাবধানে এগোতে হচ্ছিল। কিন্তু ঝাউবনের মধ্যে আলো আঁধারিতে আর তাকে দেখতে পেলাম না। গম্বুজের বাতিটাও আর জ্বলছে না তখন।”
রামু চোখ বড়-বড় করে বলে, “তখন কী করলে?”
“কিছু করার নেই। চারদিক ঠাহর করছি। লোকটা তো আর নেই হয়ে যেতে পারে না। ঝাউবনের প্রথম দিকটায় বেশ পরিষ্কার। ঝোঁপজঙ্গল তেমন নেই। কিন্তু ভিতর দিকটায় মেলা আগাছা হয়েছে, লুকিয়ে থাকার পক্ষে তোফা জায়গা। আমি একটা কাঁটাঝোঁপের কাছাকাছি ঘাপটি মেরে বসে চারদিকে দেখছি, এমন সময়
“এমন সময়? উঃ, বলো না!”
“বলছি দাঁড়াও। হাঁ করতেই গলায় একাট মশা চলে গেল যে!” খক খক করে কেশে গলা সাফ করে গবা বলে, “বেশ নিঃঝুম। আলোর চিকড়ি মিকড়ি। শীত। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ একটা লম্বা হাত কোত্থেকে বেরিয়ে
এসে ঘপাত করে আমার ঘাড়টা ধরল।”
“বলো কী?”
“ওরে বাবা, সে-কথা ভাবতে আজও গায়ে কাটা দেয়। এই দ্যাখো ফের গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।”
“তারপর কী হল?”
“আমি তো কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। আর হাতটাও পেল্লায়। এই মোটা-মোটা আঙুল, কুলোর মতো মক্ত পাঞ্জা। সেই হাতের একটু বেকায়দা বেশি চাপ পড়লে আমাদের মতো সাধারণ ঘাড় মট করে ভেঙে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, হাতটা আমার ঘাড় ধরল কিন্তু তেমন আঁট করে ধরল না। বরং মনে হচ্ছিল, মস্ত হাতটা আমার কাঁধে বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু আমি সেই ভাবেই তখন কুঁই-কুঁই করছি। টের পেলাম হাতটা সামনের কাটাঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে আমার ঘাড় ধরেছে। হাতটা মানুষের না অন্য কিছুর তা তখন বুঝতে পারছি না।”
“মানুষ নয়?”
“তখন তা বুঝবার মতো মনের অবস্থা নয়। তবে হঠাৎ ঝোঁপের ভিতর থেকে একটা খসখসে শ্বাস টানা শব্দ পেলাম। আমি তখন ভয়ে একেবারে পাথর। হঠাৎ সেই পেল্লায় হাত আমার ঘাড়ে একাট ঝাঁকুনি দিয়ে, আস্তে আস্তে ঝোঁপটার মধ্যে টেনে নিতে লাগল। সাঙ্ঘাতিক কাটাঝোঁপে আমার গাল নাক কান ছড়ে যাচ্ছে। চোখেও কাঁটা ঢুকে যেতে পারে। আমি দুহাত দিয়ে চোখটা আড়াল করলাম। তারপর ডালপালা-সমেত মুখ থুবড়ে পড়লাম মাটিতে। দেখি কী, কাটাঝোঁপের মধ্যে একটা লোক শুয়ে আছে। চারদিকে রক্তে ভেজা।”
“ওঃ বাবা!”
“বাবা বলে বাবা! আমি তো তখন বাবা ছেড়ে ঠাকুর্দাকে ডাকতে লেগেছি।”
“হল কী বলো না!”
“তেমন কিছু নয়। লোকটার তখন প্রায় হয়ে গেছে। বুকে মত ক্ষত। তা থেকে বগবগ করে রক্ত পড়ছে। লোকটার গলায় ঘড়ঘড়ানি উঠে গেছে। লোকটা কোনোক্ৰমে বলল, পাখি জানে। পাখি সব জানে। এইটুকু বলেই লোকটা ঢলে পড়ল।”
“লোকটা কে?”
“আর কে? সেই হরিহর পাড়ুই। তখনো মরেনি, কিন্তু মরছে। কিন্তু আমার অবস্থা তখন সাঙ্ঘাতিক। মরার সময় কী করে জানি না পাড়ুইয়ের হাতটা আমার ঘাড়কে শক্ত করে ধরল। কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। ওদিকে কাছাকাছি অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কারা যেন এগিয়ে আসছে। চারদিকে টর্চের বাতি ঝলসাচ্ছে ফটাফট। যারাই হোক, তারা লোক ভাল নয়। আমার পালানো দরকার। কিন্তু হরিহরের হাতখানা আমাকে অষ্টপাশে বেঁধে ফেলেছে। কার সাধ্য ছাড়ায়! তার ওপর আঙুলগুলো ক্রমে বেঁকে গলায় গজালের মতো ঢুকে যাচ্ছে। মরন্ত মানুষের গায়ে যে অত শক্তি হয় কে জানত বলো।”
“তারপর কী হল? তাড়াতাড়ি বলল।”
“ওদিকে সেই বদমাশগুলোও তেড়ে আসছে। চারদিকে টর্চের আলো ঝলসাচ্ছে। একটা লোক চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, সাতনা, ঠিকমতো বল্লম চালিয়েছিলি তো! অন্য একজন রাশভারী গলায় বলল, আমার বল্লম এদিক-ওদিক হয় না। ঝাউবনের ঢুকবার মুখেই লোকটাকে গেঁথেছি। তবে দানোটার গায়ে খুব জোর। বল্লমটা ধাঁ করে টেনে খুলেই দৌড়ে পালাল। কিন্তু মনে হয় না। বেশি দূর যেতে পারবে। চারদিকে রক্তের ছড়া দেখছ না!”
“তখন তুমি কী করলে?”
“আমি? আমি তখন কিছু করাকরির বাইরে। হরিহরের কজায় আমার পুটিমাছের পরাণ ধড়ফড় করছে। আস্তে-আস্তে চেতন ভাবটা চলে যাচ্ছে। শ্বাস প্রায় বন্ধ। ঠিক এই সময়ে লোকগুলো “ঐ যে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। পর মুহূর্তেই সবাই এসে ঘিরে ধরল আমাদের।”