আর কয়েকটা কুল খেয়ে রামু উঠে পড়ল। আন্দামান আর নিকোবর তাকে অর্ধেক কুলের ভাগ দিতে চাইলে রামু ঠোঁট উল্টে বলল, “তোরা নিগে যা।”
সন্ধ্যেবেলা গবা পাগলার ঘরে গিয়ে তাকে ধরল রামু “গবাদা! শুনেছ হবিগঞ্জের সারকাসের সেই সাপ-খেলোয়াড় লখিন্দর নাকি আসলে খুনি?”
অন্যমনস্ক গবা বলল “হ্যাঁ, খুব গুণী।”
“গুণী নয় গো, সে নাকি খুনি।” গবা অবাক হয়ে বলে, “তোমাকে কে বলল?”
“আন্দামান আর নিকোবর। কুন্দ দারোগার যমজ ছেলেরা।”
“বটে!” বলে গবা আঙুল দিয়ে তার দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, “খুন একটা হয়েছিল বটে। সেই কাশিমের চরে। গেলবারের আগের বারে শীতকালে। জায়গাটা এখান থেকে খুব দূরেও নয়। বিশ-পঁচিশ ক্রোশ হবে। খুব জ্যোৎস্না ছিল সেই রাতে।”
“তুমি সেখানে ছিলে?”
“খানিকটা ছিলাম বই কী। কাশিমের চরেই যে সেই রাতে তেনাদের নামবার কথা।”
“কাঁদের?”
“আলফা সেনটরি হল সৌরলোকের সবচেয়ে কাছাকাছি নক্ষত্র। দূরত্ব হবে চার আলোবছর। সেখানকার একটা উন্নত গ্রহের সঙ্গে আমার অনেকদিনের যোগাযোগ। বহুকাল খবর-বার্তা দিইনি বলে চিন্তা করছিল তারা। আমাকে একদিন একটা ভাবসংকেত পাঠাল। যন্ত্রপাতি দিয়ে নয়, স্রেফ জোরালো মানসিক প্রক্রিয়ায়। জানান দিল, দিন-দুইয়ের মধ্যেই তারা এক পূর্ণিমার রাতে কাশিমের চরে নামবে। আমি যেন সেখানে হাজির থাকি।”
“গুল মারছ গবাদা!”
“গবা তো কেবল গুলই মারে। আর বলব না, যাও।”
“আচ্ছা আচ্ছা, গুল নয়। বলো।”
“শেষ পর্যন্ত অবশ্য সময়মতো তারা আসতে পারেনি। পরে শুনলাম ওদের মহাকাশযানের একটা মাস্তুল নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল।”
‘মাস্তুল তো নৌকায় থাকে।”
“আরে বাবা এ কি আর সাধারণ মাস্তুল! এই মাস্তুল হল আসলে একটা সুপারসেনসিটিভ স্ক্যানার।”
“যাকগে, তারপর কী হল?”
“সে এক কাণ্ড। আমি তো কাশিমের চরে জোৎস্নায় একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমে ঢুলে পড়ছি। কখন তেনারা আসবেন। কাশিমের চর জায়গাটা বড় ভাল নয়। একধারে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে নদী। শীতকাল বলে জল প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। দু ধার দিয়ে তিরতির করে নালার মতো দুটো স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে মস্ত চর। তা সেই চরেও আবার কাশফুলের ঘন ঝোঁপ সব। মাঝখানে অবশ্য অনেকটা জায়াগ ফাঁকা। সন্ধ্যের পরই সোনার থালার মতো চাঁদ উঠল। জ্যোৎস্নায় একেবারে মাখামাখি। আর যা শীত পড়েছিল সেবার তা আর বলার নয়।”
“উঃ প্রকৃতি-বর্ণনা রেখে আসল গল্পটা বলবে তো!”
“তোমার বাপু বড় ধৈর্য কম। গল্পের আসল প্রাণই তো ঐ প্রকৃতি আর পরিবেশের ওপর। ওটা না হলে গল্পটা বড় ন্যাড়া-ন্যাড়া হয়ে যায় যে। সত্যি বলে মনে হয় না।”
“তারপর কী হল?”
“সে এক কাণ্ড। আমি তো সেই শীতে একেবারে জড়সড়ো হয়ে ঠাণ্ডা মেরে বসে আছি। চারদিকে বেশ কুয়াশা। কুয়াশার মধ্যে জ্যোৎস্নার একটা আলাদা রূপ আছে। গোটা জায়গাটাকে মনে হচ্ছিল পরীর রাজ্য। দেখতে দেখতে রাত বেড়ে উঠল। ঘুমে আমি ঢুলে পড়ছি। এমন সময় মনে হল একটা লোক যেন দূর থেকে দৌড়ে আসছে। বালির ওপর তো পায়ের শব্দ হয় না। কিন্তু আমি সেই মহাকাশের লোকগুলোর ভাবসংকেত পাওয়ার জন্য মনটাকে এমন চনমনে রেখেছিলাম যে, উঁচ পড়লেও শব্দ শুনতে পাব।”
“তবে এই যে বললে ঘুমে ঢুলে পড়ছিলে!”
“তা বটে। তবে কিনা সে-ঘুমও ভাবের ঘুম। চোখ বোজা থাকে বটে, কিন্তু কান, গায়ের চামড়া, নাক, চারদিকের খবর পায়।”
“লোকটা দৌড়ে কোথায় গেল?”
“গেল না। লোকটা আসছিল। আমি চোখ চেয়ে কুয়াশায় কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে কয়েক সেকেণ্ড পরেই আরো চার-পাঁচজনের দৌড়ে আসার আওয়াজ পেলাম। তারপর বুঝলাম প্রথম লোকটা পালাচ্ছে, পরের লোকেরা তাকে তাড়া করছে। প্রথম পায়ের শব্দটা ঝোঁপের আড়ালে-আবডালে বেড়ালের মতো চুপি চুপি ঘুরে বেড়াচ্ছে গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্য লোকগুলো তাকে খুঁজছে।”
“তুমি কী করলে?”
“আমি একটা হাই তুললাম তখন।”
“মাত্র হাই তুললে?”
“না, দুটো তুড়িও দিয়েছিলাম মনে আছে।”
“ধুস, তারপর কী হল?”
“ওঃ, সে এক কাণ্ড!”
.
১২.
বিরক্ত হয়ে রামু বলে, “আঃ, বলোই না!”
ভাবলে আজও গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়। দ্যাখো না, আমার বোর )
গা দ্যাখো!” বলে গবা হাতে দাঁড়ানো রোঁয়া দেখাল রামুকে।
তারপর বলল, “কুয়াশা আর জ্যোৎস্নার মধ্যে ঝোপেঝাড়ে সেই লুকোচুরি খেলা চলছে, আর আমি বসে আছি। ব্যাপার কী তা বুঝতে পারছি না। একবার হঠাৎ একটা শেয়াল এক ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে লাফ মেরে সাঁ করে ছুটে পালাল।
“তারপর?”
তারপর সেই ঝোঁপের আড়াল থেকে ধুতি পরা একটা লোক ব্যাপারে মুখ ঢেকে কুঁজো হয়ে বেরিয়ে এসে অবিকল শেয়ালের মতোই দৌড়ে পালাচ্ছিল। তার চেহারাটা বিশাল। ছ’ফুটের ওপরে লম্বা, ইয়া কাঁধ, ইয়া বুকের ছাতি। সেই ঝুমকো আলোয় মুখটাকা লোকটাকেও কিন্তু আমি চোখের পলকে চিনে ফেললাম।”
“লোকটা কে?”
“সেই লোকটাই পাড়ুই। ওরকম লোক আমি জন্মে দুটো দেখিনি। হরিহর পাড়ুই না-পারে এমন কোনো কাজ নেই। লোকের ছেলেমেয়ে চুরি করে আড়কাঠিদের কাছে বেচে দিত, নয়তো মা-বাপের কাছ থেকে টাকা আদায় করত। ডাকাতি করত। চুরি করত। আর খুন করা ছিল তার জলভাত। ওই তল্লাটে তার দাপটে সবাই কঁপত।”