উদ্ধববাবু গম্ভীর হয়ে বলেন, “পাখিটা আমার প্রতিনিধি হয়ে তোমাকে শাসন করবে। কথাটা মনে রেখো। যদি কখনো ফের এরকম কিছু করো তবে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেব। আর শুনলাম পড়ার মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কাটাকুটি খেলছিলে আজ! সত্যি?”
“মাস্টারমশাই নিজেই তো খেললেন।”
“সেক্ষেত্রে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু মাস্টারমশাইরা কোন ধরনের ছাত্রের সঙ্গে কাটাকুটি খেলেন তা জানো? যাদের কিছু হবে না বলে ওঁরা নিশ্চিন্ত হয়ে যান। তোমারও কিছু হবে না। এখন যাও।”
চোখ মুছতে মুছতে রামু বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
উদ্ধববাবুর কড়া হুকুম আছে কোনো ছেলেকে তিনি যেদিন শাসন করবেন যেদিন সেই ছেলের খাওয়াও বারণ। তাতে নাকি ফল ভাল হয়। সুতরাং রামুকে আজ খালি পেটে ইস্কুল যেতে হল।
ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে বসে গান্টু কাঁচা কুল খাচ্ছিল নুন দিয়ে। স্যার এখনো আসেননি।
রামু গিয়ে পাশে বসতেই গান্টু চাপা গলায় বলে, “খুব ভোলাই খেয়েছিস
রামু আবার চোখের জল মোছে।
‘দূর, আমি তো কত মার খেয়েছি। কাকা এখনো মারে। তবে এখন আর লাগে না।”
রামু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “শোন গান্টু, আমি ঠিক করেছি সার্কাসের দলে নাম লেখাব।”
“সার্কাস!”
“আমার লেখাপড়া হবে না। কিছু হবে না।”
“সার্কাসে গেলে নেবে কেন? ঝাড় দেওয়ার কাজ করবি?”
“না। খেলা দেখাব।”
“পারবি?”
“শিখব।”
১১-১৫. অনেক ভেবে চিন্তে গান্টু বলল
অনেক ভেবে চিন্তে গান্টু বলল “আমি সারকাসে যাব না। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজে চাকরি নিয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াব।”
রামু বলে, “জাহাজে চাকরি পাওয়া অত সোজা নয়। তোকে নেবে কেন? তুই সাঁতার জানিস?”
“শিখে নেব। তোকে সারকাসে নিলে আমাকে জাহাজে নেবে।”
“তাহলে পালাবি?”
“পালাব। কিন্তু গাড়িভাড়ার কী হবে? রাস্তায় খাব কী?
“সে হয়ে যাবে। আমি তো সারকাসের দলের সঙ্গে যাচ্ছি আমাকে ওরাই খেতে-টেতে দেবে।”
“আমি যদি তোর সঙ্গে থাকি তো আমাকেও নেবে?”
“সেটা এখুনি বলতে পারছি না। কথা বলতে হবে।”
ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে গান্টুর সঙ্গে নানারকম পরামর্শ করে রামু বাসার ফিরল। সারাদিন খাওয়া নেই। টিফিনে গান্টু একটু চিনেবাদামের ভাগ দিয়েছিল মাত্র। তাতে খিদেটা আরো চাগিয়ে উঠেছে। পেটের আগুনটা রাগের হকা হয়ে মাথায় উঠে আসছে। বইটই রেখে রামু নিঃসাড়ে গিয়ে বাগানে ঢুকল। বাগানের এক কোণে একটা কুলগাছ আছে। তাতে মত্ত-মত টোপাকুল খেয়ে খিদেটা চাপা দেবে।
কিন্তু গিয়ে দেখে, কুন্দ দারোগার দুই ছেলে আন্দামান আর নিকোবর চুরি করে বাগানের দেয়াল টপকে ঢুকে গাছে উঠে কুল সব সাফ করছে। একজনের হাতে আবার একটা বাঁশের চ্যাঙড়ি। সেটা টোপাকুলে টপটপে ভর্তি।
রামু হাঁক মারল, “অ্যাই! আমাদের গাছে উঠে কুল পাড়ছিস যে বড়!”
কুকুসুমের শাসন বড্ড কড়া। কুল চুরির কথা জানাজানি হলে আস্ত রাখবে না। ভয়ের ব্যাপার আরো আছে। রামুর ঢিল ছোঁড়ার হাত দারুণ পাকা। এখন নীচ থেকে সে যদি ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে তবে গাছের ওপর দুই ভাইয়ের বড়ই বিপদ। রামুর ঢিল বড় একটা ফশকায় না। তাই দুই ভাই ওপর থেকে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, “বলিস না, ভাই বলিস না। অন্যায় হয়ে গেছে। তোকে অর্ধেক দিচ্ছি। পায়ে পড়ছি, ঢিল মারিস না।”
খিদে-পেটে রামুর গাছে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তাছাড়া এ বাড়ির ওপর তার এখন এমন রাগ যে, এই বাড়ির কোন ক্ষতি হলে সে গম্ভীর হয়ে বলল, “ঠিক আছে, নেমে আয়।”
আন্দামান আর নিকোবর পকেটে করে কাগজের পুরিয়ায় অনেকটা ঝাল নুন এনেছে। তাই নিয়ে গাছতলায় তিনজনে কুলের ভোজে বসে গেল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে তিনজন কুল খেয়ে গেল। পাকা, আধ-পাকা ডাঁশা কুল আর দুর্দান্ত ঝালের শোঁসানি শোনো যাচ্ছিল কেবল। তারপর নিকোবর বলল, “তুই নাকি সারকাসের দলে ভিড়ছিস?”
রামু কথাটা আর কাউকে বলেনি, গান্টু ছাড়া। তাই চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে বলেছে?”
“গান্টু। স্কুল থেকে ফেরার পথে বলল, রামু সারকাসের দলে চলে যাচ্ছে।”
আন্দামান মুখ থেকে একটা কুলের বিচি ফুড়ুক করে ফেলে বলল, ওই সারকাসে একটা সাঙ্ঘাতিক খুনি লোক আছে। দিনে-দুপুরে মানুষ খুন করে।”
রামু বলে “কে বল তো?”
“যে লোকটা আজকাল সাপের খেলা দেখায়। মাস্টার লখিন্দর।”
“লোকটা খুনি কী করে জানলি?”
“বাবা গতকাল ফন্তুবাবুকে বলছিল, আমি আড়াল থেকে শুনেছি।”
“ফন্তুবাবুটা কে?”
“পুলিসের ইনফর্মার।”
“কী বলছিল?”
“বলছিল লখিন্দরের নাম নাকি আসলে লখিন্দর নয়। এ হচ্ছে মাস্টার গোবিন্দ। কাশিমের চরে হরিহর পাড়ুই বলে একটা লোককে খুন করে জেলে যায়। তার ফাঁসির হুকুমও হয়েছিল। কিন্তু লোকটা জেল থেকে পালিয়ে এসেছে।”
“তবে তোর বাবা তাকে ধরছে না কেন?”
“ধরা যাচ্ছে না লোকটা মুখোশ পড়ে থাকে তো। আসল চেহারাটা কেউ দেখেনি। সারকাসওয়ালারা অন্য একটা লোককে দেখিয়ে বলছে, এই হচ্ছে মাস্টার লখিন্দর।”
“তাহলে তোর বাবা এখন কী করবে?”
“কিছু করবে না। শুধু ওয়াচ করা হবে। মাস্টার গোবিন্দর সব খোঁজ খবর চেয়ে পাঠানো হয়েছে। পুলিস ফোর্সও আসছে। শহরটা ঘিরে ফেলা হবে। এখন ইনফর্মার আর সেপাইরা চারদিকে নজর রাখছে। গতকাল থেকে সারকাসে সাপের খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। বিরাট নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে–মাস্টার লখিন্দর পেটের পীড়ায় আক্রান্ত। সাপের খেলা বন্ধ রইল। সব প্ল্যান করা।”