পাখিটা দাঁড়ের একদিকে সরে গিয়ে জড়সড়ো হয়ে বসে বলে “বিশু! আমাকে মোয়রা না বিশু! আমি বুড়ো মানুষ। মরার সময় সব মোহর তোমাকে দিয়ে যাব।”
রামু রাগে দাঁত কিড়মির করে বলে, “আমার মোহরের দরকার নেই।” তুই চেঁচানি বন্ধ করবি কি না বল।”
পাখিটা হঠাৎ ডানা ঝাঁপটে, পায়ের শিকলের শব্দ করে ঠিক উদ্ধববাবুর মতো একটু কাসে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে “পড়তে বসো। পড়তে বোসস। সময় নষ্ট কোরো না।”
পাখিটা পুরনো বুলি সব ভুলে যায়নি এখনো। নতুন বুলিও শিখেছে। তবে আর কয়েকদিনের মধ্যেই পাখিটা নতুন বুলিই বলতে থাকবে ক্রমাগত। রামুর তখন ভারী বিপদ হবে। সুতরাং পাখিটাকে না ভাগানো পর্যন্ত রামুর শান্তি নেই।
কাকাতুয়া যে সব নিরীহ প্রাণী নয় তা রামু বুঝল শিকলটা খুলতে গিয়ে যেই না দাড়ে হাত দিয়েছে, অমনি পাখিটা খচ করে ঠুকরে দিল হাতে। ডান হাতের বুড়ো-আঙুলের পিছন দিকটা কেটে গেল একটু।
কাটাকুটিকে অবশ্য রামু ভয় পায় না। প্রতিদিনই তার হাত কাটছে, মাথা ফাটছে, পা মচকাচ্ছে। ওসব গা-সওয়া। সে বাইরে গিয়ে একটু দুর্বোঘাস তুলে হাতে ডলে নিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়।
যারা লেখাপড়ায় ভাল হয় না তারা হয়তো বা খেলাধুলো, গান-বাজনা, ছবি-আঁকা বা অন্য কোনদিকে ভাল হয়। রামুর ভাইবোনরা লেখাপড়ায় সবাই। ভাল। বোনরা ভাল গায়, বড়দা দারুণ তবলা বাজায়, ছোড়দা দুর্দান্ত স্পোর্টসমান। রামু কোনোটাতেই ভাল নয়। ক্লাসে টেনেটুনে পাস করে যায়. বার্ষিক স্পোর্টসে বড়জোর হাইজাম্প বা দৌড়ে একটা বা দুটো থার্ড প্রাইজ পায়। গান জানে, ছবি আঁকতে পারে না। কিন্তু শরীরের সেই অদ্ভুত কাতুকুতুটার জ্বালায় সে সাংঘাতিক, সাংঘাতিক সব দুষ্টুমি করে বেড়ায়। দুষ্টু ছেলেরা সাধারণত মায়ের আদর একটু বেশিই পায়। কিন্তু রামুর কপালটা সেদিক দিয়েও খারাপ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তার আদরই বাড়িতে সবচেয়ে কম। আসল কথা হচ্ছে তার দিকে কারো তেমন নজর নেই। রামু বলে একটা ছেলে এ বাড়ীতে থাকে মাত্র। যেমন নয়নকাজল থাকে, যেমন মাঝে-মাঝে গবা পাগলা থাকে। রামুর সন্দেহ হয়, সে নিরুদ্দেশ হলে এ বাড়ির লোকে ঘটনাটা লক্ষ্য করবে কি না।
বাইরের সিঁড়িতে বসে রামু আজ সকালে এইসব ভাবছিল। তার জীবনে শান্তি নেই।
রোদ উঠল। দাদাদিদিরা পড়ার ঘরে পড়তে বসল। আর যুধিষ্ঠির মাস্টারমশাইও দেখা দিলেন।
যুধিষ্ঠিরবাবুকে রামুর বড় ভাল লাগে। ভারী অমায়িক মানুষ। কথায় কথায় মারধর নেই, ধমক-ধামক নেই। মিষ্টি হেসে নরম সুরে বোঝান, না পারলে রাগ করেন না। আজও রামুকে জিজ্ঞেস করলেন, “মুখোনা ভার দেখছি যে। বকুনি খেয়েছ নাকি?”
“আজ কিছু ভাল লাগছে না মাস্টারমশাই।”
“সকালবেলায় কিছু ভাল না লাগলে সারা দিনটাই খারাপ যায়। সকালটাই তো মানুষের সবচেয়ে সুন্দর সময়।”
যুধিষ্ঠিরবাবুর পরনে ধপধপে ধুতি। গরম কাপড়ের নস্যি রঙের পাঞ্জাবির ওপর শাল। তার চেহারাখানাও বেশ লম্বা চওড়া। বয়স বেশি নয়। চোখের দৃষ্টি সব পরিষ্কার আর তীক্ষ্ম। অগাধ জ্ঞান। রামু শুনেছে যুধিষ্ঠিরবাবু খুব বড়লোকের ছেলে। বাবার সঙ্গে রাগারাগি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। নইলে তার যা অবস্থা তাতে রোজগার না করলেও চলে।
রামু গম্ভীর হয়ে বলে, “আজ যদি না পড়ি তাহলে কি আপনি রাগ করবেন?”
“না না। বোজ কি পড়তে ভাল লাগে?”
“কিন্তু বাবা তো বকবে?”
“না, তাও বকবেন না। চলো, তোমার দাদা আর দিদিদের পড়া দিয়ে তোমার সঙ্গে বসে আমি কাটাকুটি খেলব।”
“সত্যি খেলবেন?”
“কেন খেলব না? চলল।”
বাস্তবিকই যুধিষ্ঠির মাস্টারমশাই আর সকলকে শক্ত-শক্ত টাস্ক করতে দিয়ে একটা রাফ খাতা খুলে রামুর সঙ্গে কাটাকুটি খেলতে লাগলেন। কিন্তু কাটাকুটিও উনি এত ভাল খেলেন যে, রামু বারবার হেরে যেতে লাগল।
যুধিষ্ঠিরবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, “তোমার হাত কাটল কী করে?”
“আমাদের পাখিটা কামড়ে দিয়েছে।”
“সেই কাকাতুয়াটা?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি কী করেছিলে?”
“ছেড়ে দিচ্ছিলাম।”
“পাখিটাকে?”
“হ্যাঁ। আমাকে বড় জ্বালাতন করে।” যুধিষ্ঠিরবাবু একটু চমকে উঠে বলেন, ছেড়ে দিয়েছ?”
“না, শিকলটা খুলতে পারিনি।”
এরপর আর কোন কথা হল না বটে কিন্তু যুধিষ্ঠিরবাবু বারবার কাটাকুটি খেলায় হেরে যেতে লাগলেন। মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কাটাকুটি খেলার ঘটনা এবং পাখিটাকে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টার কথা রামুর দাদা আর দিদিরা বাড়িতে বলে দিল। উদ্ধববাবু কাঁচারিতে যাওয়ার আগে রামুকে নিজের ঘরে ডাকিয়ে আনলেন।
গম্ভীর হয়ে বলছেন, “পাখিটা তোর সঙ্গে কোনো শত্রুতা করেছে?” রামু ভয়ে কাঠ। গলা দিয়ে স্বর বেরোল না।
উদ্ধববাবু তার বেতের ছড়িটা দিয়ে শপাৎ করে এক ঘা মেরে বললেন, “দুনিয়ার সবাইকে শত্রু মনে করতে কে তোমাকে শেখাল?
রামু যন্ত্রণায় ছটফট করে বাঁ হাতের কবজি চেপে ধরল। বেতটা লেগেছিল সেইখানেই।
“বলো!” আবার শপাং। এবার লাগল কোমরে। রামু বেঁকে গিয়ে বলল “পাখিটা আমাকে ধমকাচ্ছিল।”
“বটে! পাখির ধমকে তোমার এমন অপমান হয়েছে যে, শিকলি কেটে তাকে উড়িয়ে দিতে হবে?”
আবার শপাং। এবার পিঠের চামড়াই বুঝি কেটে গেল রামুর। সে একটা চিৎকার করতে গিয়েও দাঁত চেপে রইল। বাবার সামনে কান্না বারণ। তবে সে চাপা কান্নায় থরথর করে কাঁপছিল। রাগেও।