সামন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, “বুঝলাম, কিন্তু কথাটা কী?”
“কথা কী একটা? কথা অনেক।”
“সংক্ষেপে বলে ফেল।”
“বলছিলাম কী, এসব কি খেলা নাকি? বিষ্ণুপুরের ওরিয়েন্ট সার্কাস কী দেখাচ্ছে জানেন?”
“কী দেখাচ্ছে?”
“ট্রাপিজ-ফাপিজ নেই স্রেফ শূন্যে কিছু লোক উড়ে বেড়াচ্ছে। আপনি তারের খেলা দেখাচ্ছেন, তারা দেখাচ্ছে বেতারের খেলা। এ-খুঁটো থেকে ও-খুঁটো কেবল একটা বাতাসের দড়ি টাঙানো, তারই ওপর দিয়ে তোক সাইকেল চালাচ্ছে, হেঁটমুণ্ড হয়ে কসরত করছে। তাছাড়া আপনি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, আপনাদের বামনবীর মাত্র আড়াই ফুট লম্বা, আর ওরা কী দিয়েছে জানেন? ওরা বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আমাদের বামনবীর মাত্র তিন ফুট বেঁটে।”
“তাই নাকি?”
“আলবত তাই। লম্বাই যদি হবে, তবে আর বেঁটে বললেন কী কবে? বলতে হলে এরকমই বলতে হয়, আমাদের বামনবীর তিন ফুট বেঁটে বা চার ফুট বেঁটে বা পাঁচ ফুট বেঁটে বা ছয় ফুট বেঁটে বা–”
“থাক থাক। আর বলতে হবে না।”
“বুঝেছেন তো?”
“বুঝেছি।”
“কী বুঝলেন?”
“বুঝলাম তুমি খাঁটি পাগল।”
গবা মাথা নেড়ে বলে, ভাল মানুষদের তো ঐ একটাই দোষ। তারা পাগলকে ভাবে পাগল। পাগলরা যে সত্যিই পাগল তা কি পাগলরা জানে না? আর তারা যে পাগল সেইটে বোঝানোর জন্য কোনো পাগল কি পাগল ছাড়া অন্য কোনো পাগলের কাছে যায়? বলুন!”
সামন্ত জ্বালাতন হয়ে বলে, “তাও বুঝলাম। কিন্তু বাপু হে, আজ আমার মনটা ভাল নেই।”
“মন ভাল করার ওষুধ আমি জানি।”
“বটে! কী ওষুধ?”
“একদম পাগল হয়ে যান। ভাল মানুষরা যদি পাগল না হয়, তাহলে পাগলরা যে পাগল তা বুঝবে কী করে? আর একবার যদি পাগল হয়ে পাগলামির মজা টের পায়, তবে কি আর মন খারাপ থাকে?”
“ওঃ!” বলে সামন্ত নিজের মাথা চেপে ধরল।
গবা বলল, “এই কথাটাই বলতে আসা মশাই। তবে যাওয়ার আগে, দুচারটে আজে-বাজে কথাও বলে যাই। কথাটা হল, গোবিন্দ মাস্টার খড়ের গাদায় পৌঁছেছে। রাত্রে স্পাই আসবে। রামু নামে একটা ছেলে আসতে পারে খেয়াল রাখবেন।”
বলে গবা উঠে পড়ল। সামন্ত মুখ তুলে হাঁ করে চেয়ে থাকে।
গবা এরেনাটা পার হওয়ার সময় তাচ্ছিল্যের মুখভঙ্গি করে খেলোয়াড়দের কসরত দেখে বক্রেশ্বরের দিকে চেয়ে বলে, “আড়াই ফুট লম্বা! হুঁ লম্বাই যদি হলে তবে বেঁটে বলে অত বড়াই কেন?”
বক্রেশ্বর চোখ পিটপিট করে বলে, “তুমিও যেমন পাগল আমিও তেমনি লম্বা।”
গবা আর কথা বাড়ায় না। বেরিয়ে সোজা হাঁটতে থাকে। রবিবার বলে আজ একটু বেলায় বাজার করে হরিহরবাবু আর গদাধরবাবু ফিরছিলেন। গবার সঙ্গে রাস্তায় দেখা।
গদাধরবাবু গদগদ হয়ে বললেন, “এই যে বৈজ্ঞানিক গবা তোমার সারানো ঘড়িটা অদ্ভুত চলছে হে। একেবারে ঘন্টায় মিনিটে সেকেণ্ডে।”
হরিহরবাবু সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “তবে উল্টোদিকে। গদাধরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “দেখুন হরিহরবাবু-”
হরিহরবাবুও সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “কী বলবেন তা জানি গদাধরবাবু। তবে বলে লাভ নেই, গবা বিজ্ঞানের ব-ও জানে না। ও গবা, বলো তো, কাইনেটিক এনারজি কাকে বলে!”
গবা একটা প্রকাণ্ড হাই তুলে বলে, আপনিই তো বলে দিলেন। “তার মানে?”
“কাইনেটিক এনারজিকেই কাইনেটিক এনার্জী বলে। খুব সোজা কথা।” হরিবাবু একগাল হেসে বলেন, “দেখলেন তো গদাধরবাবু, গবা কাইনেটিক এনারজি কাকে বলে জানে না।”
গদাধরবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কে বলল জানে না? এই এই তোত বলল শুনলেন না? কাইনেটিক এনারজিকেই কাইনেটিক এনারজি বলে?”
দুজনের মধ্যে আবার একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠল।
কিন্তু গবার সময় নেই। সে দ্রুত পায়ে চলেছে শহরের আর এক প্রান্তে। একটা খড়ের গাদায়।
.
১০.
পাখিদের মুশকিল হল তারা পুরনো কথা বেশিদিন মনে রাখতে পারে না। মস্তিষ্কের ততখানি ক্ষমতা তাদের নেই, স্মৃতিশক্তিও নেই। কিছুদিনের মধ্যেই তারা পুরনো বুলি ভুলে নতুন বুলি শিখতে শুরু করে। আজ সকালে রামুর ঘুম ভেঙেছে পাখিটার ডাকে। কাকভোরে পাখিটা হঠাৎ বিকট স্বরে ডাকতে শুরু করে, রামু ওঠো, রামু ওঠো, রামু ওঠো। মুখ ধুয়ে নাও। পড়তে বোসা।
রামু তো অবাক। সে ধরে নিয়েছিল, পাখিটা নতুন বুলি কিছুতেই শিখবে। তাই নিশ্চিন্ত ছিল। একটা পাখি তার ওপর খবর্দারি করবে এটা কি সহ্য হয়? কিন্তু আজ সকালে এই অদ্ভুত কণ্ড দেখে সে হতবাক। পাখিটা যে শুধু ডাকছে তা নয়, বেশ রাগের গলায় ধমকাচ্ছে। যেমনটা তার বাবা উদ্ধববাবু করে থাকেন, হুবহু সেই স্বর। ডাকছেও পাশে বাবার ঘর থেকেই। পাখির দড়টা আজকাল উদ্ধববাবুর ঘরেই ঝোলানো থাকে।
শীতের ভোরে এখনো চারিদিক বেশ অন্ধকার। তার ওপর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। এই শীতে লেপের ওম থেকে বেরোবার সময় মনে হয়ে কেউ বুঝি
গা থেকে চামড়াটা টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে।
রামু হয়তো পাখির ডাককে উপেক্ষা করে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতো। কিন্তু পাখিটার বিকট চেঁচামেচিতে উদ্ধববাবুরও ঘুম ভেঙেছে। তিনিও উঠে গম্ভীর গলায় হাঁক দিলেন, “এই রেমো! ওঠ!”
রামু মনে মনে রাগ চেপে রেখে ওঠে এবং শীতে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে খুঁটের ছাই দিয়ে দাঁত মেজে পাথুরে ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুয়ে নেয়। তারপর ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রণাম করার নিয়ম।
একটা খদ্দরের চাঁদর মুড়ি দিয়ে সে যখন পড়ার ঘরে এল তখন উদ্ধববাবু প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে গেছেন। রামু বাবার ঘরে ঢুকে কটমট করে পাখিটার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই ভেবেছিসটা কী শুনি?”