উদ্ধববাবুর ছেলেমেয়েরাও পড়া ভুলে বাবার দিকে চেয়েছিল। এবার তারা নিজেদের মধ্যে তাকাতাকি করতে লাগল। যুধিষ্ঠিরও খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। পান, কাকাতুয়া, ঘুম এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে তারা সবাই অবাক।
উদ্ধববাবু বুঝতে পারছেন, আদালতে দাঁড়িয়ে যত ভাল সওয়ালই করুন কেন আজ ছেলেমেয়েদের সামনে তাদের মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে সওয়াল জবাব করতে গিয়ে তিনি নিতান্ত আহাম্মক বা পাগল বলে প্রমাণ হচ্ছেন।
যুধিষ্ঠির অবাক হলেও কথায় তা প্রকাশ করলেন না। বিনীত ভাবেই বললেন, “আজ্ঞে আমার বরাবরই ভাল ঘুম হয়। কাল রাতেও মড়ার মতো ঘুমিয়েছি।”
“বেশ বেশ।” বলে উদ্ধববাবু তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন। গবাটাকে হাতের কাছে পেলে মাথায় কষে একটা গাট্টা লাগাতেন।
কিন্তু গবা হাতের কাছে ছিল না।
.
০৯.
সকালবেলায় সার্কাসের খেলোয়াড়রা ট্রেনারের নির্দেশে কসরত করছিল। আসল যে-সব খেলা তারা দেখায়, তার চেয়েও এই কসরত বেশি কঠিন।
কক্সরতের সময় ট্রাপিজের জন্য নীচে জাল টাঙানো হয়েছে। জালের ওপর অনেক উঁচুতে, শূন্যে ট্রাপিজ-শিল্পীরা দোল খাচ্ছে। জালের নীচে চলছে সাইকেল, বীম ব্যালানস ইত্যাদি। এক ধারে শক্ত করে দুটো খুটিতে বাঁধা তারের ওপর চলছে শীর্ষাসন, এক-চাকার সাইকেলে একজনকে কাঁধে নিয়ে আর-একজন এপার-ওপার হচ্ছে আগু-পিছু করে। জোকাররা নানারকম ডিগবাজীর ভেলকি লাগাচ্ছে এরেনার অন্য ধারে। দামি সীটের একটা চেয়ারে বিমর্ষ মুখে বসে দেখছে সামন্ত। পুলিশ পিছনে লেগেছে, এখানকার ডেরাডাণ্ডা শিগগিরই তুলতে হবে। কিন্তু তুললেই যে রেহাই মিলবে এমন নয়। কাশিমের চরে হরিহর পাড়ুই খুন হওয়ার পর কিছুদিন পুলিসের জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। গোবিন্দকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ঝামেলা মিটেছিল বটে, কিন্তু গোবিন্দের শোকে সামন্তর আহার-নিদ্রা ঘুচে গিয়েছিল। গোবিন্দ ফিরেছে, সেই সঙ্গে ঝামেলাও। মেরে ফেললেও অবশ্য সার্কাসের কেউই পুলিসের কাছে স্বীকার করবে না যে, গোবিন্দ এখানে লুকিয়ে আছে। কিন্তু তাতে আর কতটুকু কী লাভ হবে? ভেবে-ভেবে সামন্তর মাথা গরম, মন উচাটন।
একটা উটকো লোক হঠাৎ তাঁবুতে ঢুকে পড়ায় একটা শোরগোল পড়ে গেল। সামন্ত চোখ তুলে দেখে, একটা পাগল। গায়ে আল-পাকার কোট, গালে দাড়ি, ময়লা পাতলুন। লম্বা-লম্বা চুলে জট পড়েছে। বেঁটে জোকার বক্রেশ্বর রে-রে করে তেড়ে গেল তার দিকে। লোকটা বক্রেশ্বরকে লক্ষই করল না। চারদিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “ছোঃ, এইসব খেলা দেখিয়ে তোক ঠকাও নাকি তোমরা?”
বক্রেশ্বর যখন খেলা দেখায় তখন তার হাতে একটা চুষিকাঠি থাকে। সেইটেই সে লাঠির মতো ব্যবহার করে। এখনো সেইটে বাগিয়ে ধরে বলল, “দেব নাকি কয়েক ঘা?”
লোকটা বক্রেশ্বরকে ভাল করে দেখার জন্য কোটের পকেট থেকে একটা দূরবীন বের করে চোখে লাগায়। ভাল করে দেখে নিয়ে বলে, “তোমার চেয়ে ঢের বেঁটে লোক দেখেছি। অত কায়দা দেখিও না।”
বক্রেশ্বর বুক ফুলিয়ে বলে, “আমি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেঁটে মানুষ। নইলে আমাকে ঠাহর করতে তোমার দুরবীন লাগল কেন হে?”
লোকটা হেসে বলে,”অ্যায়সা বেঁটে মানুষও আছে, যাকে দেখতে মাইক্রোস্কোপ লাগে। যাও, যাও মেলা বোকো না।”
বক্রেশ্বর চুষিকাঠিটা তুলে মারতে গেল। কিন্তু হঠাৎ কী ভেবে থমকে গিয়ে খানিকক্ষণ লোকটার দিকে চেয়ে থেকে বলে, “আরে! চেনা-চেনা লাগছে যে।”
“আমাকে সবাই চেনে। আমি হচ্ছি গবা পাগলা।”
সাজা-পাগল? না হওয়া পাগল?”
“আসলে পাগল হে, আসল পাগল?”
“বেশি বোকো না, তোমার চেয়ে ঢের বেশি পাগল লোক আমি দেখেছি।”
“দেখেছ? সত্যি?”
“সেই-সব পাগলকে দেখলেও বোঝা যায়, এই হচ্ছে খাঁটি পাগল। তাকে বলতে হয় না, আমি অমুক পাগলা।”
গবা মুখ বিকৃত করে বলল, “এমন পাগলামি দেখাতে পারি যা দেখলে তোমরা পিণ্ডি চটকে যাবে। কিন্তু এখন কাজে আসা, পাগলামির সময় নেই। সামন্তমশাইকে দুটো কাজের কথা জিজ্ঞেস করে যাব। তিনি কোথায়?”
বক্রেশ্বর চোখ পিটপিট করে লোকটাকে দেখে হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল, “বলি ও ভাই পাগলা গবা! আর কতকাল পাগলা রবা? গোল ছেড়ে কও আসলকথা। পা নেই তার পায়ে ব্যথা।”
লোকটা মুখ বেঁকিয়ে বলে, “ভূতের সর্দি সারে, রাবণ যদি রামকে মারে, ঈশ্বর যদি বক্র তবে, গবা পাগল কেন হবে?”
বক্রেশ্বর আর গবার এই তকরারে কেউ মনোযোগ দিচ্ছিল না। যে যার কাজে ব্যস্ত। বক্রেশ্বর চোখ পিটপিট করে আবার ফিক কর হেসে বলল, “চাঁদ বদনখানা দাড়িগোঁফে বড়ই ঢাকা, তবু চেনা-চেনা ঠেকছে হে। গলার স্বরটা লুকোতে পারোনি। তা চেনা যখন দিতে চাও না, আমারই বা কী এমন দায় ঠেকেছে চিনবার। ওই হোথা সামন্তমশাই বসে আছেন। চলে যাও সিধে।”
হাত তুলে বক্রেশ্বর সামন্তকে দেখিয়ে দেয়।
গবা গিয়ে সামন্তর পাশের চেয়ারে বেশ জুত করে বসে বলে, “এবার ঠাণ্ডাটাও পড়েছে মশাই।”
সামন্ত লোকটাকে বিরিক্তির চোখে দেখে বলে, “কী চাই?”
গবা একটু অপমান বোধ করে বলে, “ভাল লোকেদের একটা দোষ কী জানেন? তারা পাগল-ছাগলকে পাত্তা দিতে চায় না। তারা ভাবে, পাগলগুলো সত্যিই পাগল। তা পাগলগুলো কি আর পাগল নয়? তারা তো পাগলই। কিন্তু ভালো লোকগুলো এমন পাগল না মশাই, কি বলব আপনাকে….হিঃ হিঃ….পাগলগুলো যদি ভাল লোক হত তাহলে দেখতে পেত, আসলে ভাল লোকগুলোই এমন পাগল যে পাগলকেই কেবল পাগল ভাবে।”