সামন্ত মাথা নেড়ে বলে, “আছে। চিন্তা করবেন না।”
কুন্দকুসুম বলেন, “আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমার এই আচরণের অর্থ কী! বলতে বাধা নেই, সেদিন সেই সাপের খেলা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। কোনো মানুষের অত অ্যাজিলিটি থাকতে পারে তা জানতাম না। কিন্তু মনে হয়েছিল মাস্টার লখীন্দরের আসল নাম মাস্টার লখীন্দর নয়। মুখোশের আড়ালে লোকটি কে সেটা জানাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।”
সামন্তের চোখে উদ্বেগটা বাড়ল। বলল, “আজ্ঞে সে আর বেশি কথা কী? হকুম করলেই তাকে সামনে হাজির করতাম। খামোখা এত কষ্ট করতে গেলেন।
কুকুসুমের আচরণটা যে অদ্ভুত ঠেকছে লোকের চোখে, তা তিনি জানেন। কিন্তু তার জন্য লজ্জা পেলেন না। লজ্জা পাবার অভ্যাস তার নেই।
তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, “পুলিশের কাজ একটু অন্যরকম হয়। সবসময় সোজা পথে-চললে আমাদের চলে না। ঠিক আছে, লখীন্দরকে একবার ডাকুন।”
আবার সামন্তর ইঙ্গিতে একজন বেরিয়ে যায়। মিনিটখানেকের মধ্যেই বেশ ছমছমে চেহারার এক ছোঁকরা তাবুতে ঢুকে কুন্দকুসুমকে নমস্কার করে দাঁড়ায়।
কুন্দকুসুম চোখ দিয়ে লোকটাকে মেপে নিচ্ছিলেন। আরেকদিকে লোকটা অবিকল লখীন্দরের মাপসই বটে সন্দেহ নেই। কিন্তু কুকুসুমের চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা আসল লখীন্দরের একটু বেশি মাত্রায় ছোট ছিল। তিনি একটু বিস্ময়ের গলায় বললেন, “এই কি সেই?”
“আজ্ঞে। দলছুট হয়ে গিয়েছিল। ওর ঠাকুরমার খুব অসুখ। তাঁকে দেখতে দেশের বাড়িতে যাওয়ায় এখানে প্রথমে খেলা দেখাতে পারেনি। অদ্য ফিরেছে।”
“হুঁ।” বলে কুন্দকুসুম ছেলেটার দিকে চেয়ে বলেন, “তোমার নাম কি?”
“লখীন্দর। লখীন্দর কর্মকার।“
“আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পারো।”
কুন্দকুসুম যে সন্তুষ্ট হননি, তা টের পেল সামন্ত। মুখে উদ্বেগটা বাড়ল। বলল, “লুচি ভাজা হচ্ছে। একটু বসে যান দারোগাবাবু।”
“নাঃ, কাজ আছে।” বলে কুন্দকুসুম উঠলেন।
বাড়িতে ফিরে সেদিন কুলকুসুম তার দুই ছেলে আন্দামান আর নিকোবরকে খুব পেটালেন, পড়ার টেবিলে বসে কাটাকুটি খেলছিল বলে। আসলে সেটা কারণ নয়। খুব রেগে গেলে কুকুসুমের রাগ পড়ে একবার কাউকে ধরে বেধড়ক পেটালে।
বাসায় এসে তিনি আড়কাঠিকে ডেকে পাঠালেন। সুড়ুঙ্গে চেহারার ধুর্ত লোকটা এসে দাঁড়ালে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর খবর ঠিক তো?”
“আজ্ঞে একদম পাকা।”
“সামন্ত কিন্তু অন্য এক ছোঁকরাকে দেখাল।” সামন্ত খুনিটাকে আড়াল করছে।”
“আচ্ছা যা। চোখ কান খোলা রাখিস।”
যুধিষ্ঠির রায় সকালবেলায় যথারীতি পড়াতে এসেছেন। নিপাট ভালমানুষ। সাদা ধুতি আর সাদা শার্ট পরেন। অল্পবয়সী। চোখেমুখে লেখাপড়া এবং বুদ্ধির ছাপ আছে। তবে দোষের মধ্যে জর্দা দেওয়া পান খান।
উদ্ধববাবু তক্কেতক্কে ছিলেন। কাছারি-ঘরে মক্কেলদের ভিড় ছিল খুবই। তবু এক ফাঁকে এসে ছেলেদের পড়ার ঘরে হানা দিলেন। উদ্ধববাবু কোনরকম নেশা পছন্দ করেন না। তিনি নিজে সুপুরিটা পর্যন্ত খান না। বাচ্চাদের পড়ার ঘর জর্দার গন্ধে ম-ম করছে। তিনি একটু নাক কোচকালেন। গন্ধটা খারাপ নয়। বরং বেশ ভাল দামি আতরের গন্ধই। কিন্তু বাচ্চাদের শিক্ষকরা যদি নেশা-টেশা করেন, তাহলে শিশু-মস্তিষ্কে তার প্রভাব পড়তে পারে।
উদ্ধববাবু গলা খাকারি দিলেন। যুদ্ধিষ্ঠির খুব নিবিষ্ট মনে রামুকে অঙ্ক করাচ্ছিলেন। শব্দ শুনে শশব্যক্তে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “কিছু বলবেন?”
উদ্ধববাবু ছেলেবেলা থেকেই শিক্ষকদের সম্মান করতে শিখেছেন। তার মতে দেশের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ হলেন শিক্ষকেরা। রাষ্ট্রের উচিত প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির চেয়ে শিক্ষকদের বেশি সম্মান দেওয়া। নইলে শিক্ষকের ওপর ছাত্রদের শ্রদ্ধা আসে না। আর শ্রদ্ধা ছাড়া জ্ঞান আসবে কী করে?
উদ্ধববাবু খুব বিনীতভাবে হাতজোড় করে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “আজ্ঞে কথা সামান্যই। আপনার ব্যক্ত হওয়ার কিছু নেই। বসুন।”
যুধিষ্ঠির বসলেন। কিন্তু উদ্ধববাবু কথাটা কীভাবে শুরু করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি উকিল মানুষ। পাজি-বদমাশ খুনে দেখে-দেখে চোখ পেকে গেছে। সেই অভিজ্ঞ চোখে যুধিষ্ঠিরের মধ্যে কোনো খুনির লক্ষণ দেখলেন না।
উদ্ধববাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “ইয়ে, আপনার পান খাওয়ার অভ্যাস আছে দেখছি।”
“আজ্ঞে। পান খেলে আমার কনসেনট্রেশনটা ভাল হয়।”
“তা ভালই। ইয়ে, বলছিলাম কী, আপনি কি রাত্রিবেলায় পান-জর্দা খান?”
যুধিষ্ঠির একটু অবাক হয়ে বলেন, “আজ্ঞে না! সারাদিনে এই সকালবেলাই একটা। ব্যস।”
উদ্ধব মাথা চুলকে বললেন, “গবাটা যে কী সব আবোল-তাবোল বকে তার ঠিক নেই।”
“গবা কে?”
“ওই একটা পাগল আছে। এ-বাড়িতেই থাকে।”
যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে বলেন, “গবা পাগলা?”ওঃ হোঃ, তার কথা সব শুনেছি। লোকে বলে লোকটা নাকি ছদ্মবেশী বৈজ্ঞানিক। তার সঙ্গে একবার দেখা করার খুব ইচ্ছে আছে।”
উদ্ধববাবু দুম করে জিজ্ঞেস করলেন “আমাদের বাড়িতে একটা কাকাতুয়া আছে তা কি আপনি জানেন?”
যুধিষ্ঠির আরো একটু অবাক হয়ে বললেন, “জানি বই কী। রামুর মুখে শুনছিলাম আপনাদের কাকাতুয়াটা নাকি গুপ্তধনের কথা বলে।”
উদ্ধববাবু একটু রাগত চোখে রামুর দিকে তাকিয়ে নিলেন। তারপর যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন, “কাল রাতে আপনার ভাল ঘুম হয়েছিল তো?”