“আমারও তাই মনে হয়। দেখব’খন খোঁজ নিয়ে।”
শেষরাতে যখন গোটা সার্কাসের চত্বরটা ঘুমে অচেতন, তখন হঠাৎ নিঃশব্দে একটা ছায়ামূর্তি বাঘের খাঁচার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার চেহারা বিশাল দশাসই। কিন্তু হাঁটাচলা বেড়ালের মতো ক্ষিপ্র এবং নিঃশব্দ।
ছায়ামূর্তি সবচেয়ে কাছের ছোট্ট একটা তাবুর দরজার পর্দা তুলে ঢুকে যায়। তার হাতে খোলা রিভলভার এবং টর্চ। টর্চটা জ্বেলে সে ঘুমন্ত লোক দুটোকে দেখে। এরা নয়।
আবার ক্ষিপ্র ও নিঃশব্দ গতিতে বেরিয়ে আসে ছায়ামূর্তি, আর একটা তাবুতে ঢোকে। এখানে চারজন লোক ঘুমিয়ে আছে। টর্চ জ্বেলে ছায়ামূর্তি তাদের ভাল করে দেখে নেয়। না, এরাও নয়।
ছায়ামূর্তি একের পর এক তাঁবুতে হানা দেয়। কিন্তু যে লোকটাকে দেখবে বলে আশা করছে তাকে কোথাও দেখতে পায় না।
শেষ তাবুটা একটু দূরে। খুব ছোট্ট। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। এমন কী ফটকটায় তালা লাগানো।
ছায়ামূর্তি একটু দাঁড়ায়। তারপর চারদিকে চেয়ে দেখে নিয়ে টপ করে। কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে যায়।
রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে লোকটা খুব সতর্কতার সঙ্গে চারদিক দেখে নেয়। তারপর খুব সাবধানে পর্দাটা ফাঁক করে টর্চ জ্বালে। অস্ফুটস্বরে বলে, “আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্য!”
আশ্চর্য হওয়ারই কথা। তবুটার মধ্যে কিছুই নেই। এমনকী, অন্যান্য তাঁবুর মতো একটা খাঁটিয়াও না, মানুষ তো দূরের কথা।
ছায়ামূর্তি টর্চটা জ্বেলে চারদিকে ঘুরে ঘুরে খুব ভাল করে দেখে না, এই তাবুটা এখানে কেউ ব্যবহার করেনি। কিন্তু এই ফাঁকা তাবুটার জন্য এত সতর্কতা কেন তা ছায়ামূর্তি চমকে উঠে স্থির হয়ে দাঁড়াল। বাইরে একটা ঢিল পড়ার শব্দ হল না? বেশ বড় একটা ঢিল।
ছায়ামূর্তি খুব সতর্কতার সঙ্গে দরজার কাছে আসে এবং বাইরে উঁকি মারে। চারদিকে আজ বেশ কুয়াশা আছে। ভীষণ ঠাণ্ডা। শেষরাতের একটু জ্যোৎস্নায় চারদিক খুব আবছা দেখা যায়।
ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসার জন্য বাইরে পা দিতেই ঘটনাটা ঘটল।
পিছন থেকে হঠাৎ কে যেন বজ্রকঠোর হাতে পেঁচিয়ে ধরল তার গলা। তারপর হাঁটু দিয়ে কোমর ঠেসে ধরল। ছায়ামূর্তি নিজে প্রচণ্ড শক্তিশালী লোক। গায়ের জোরে তার জুড়ি নেই। সুতরাং সে এক ঝটকায় হাতের বাঁধনটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। যে তাকে ধরেছে সে শুধু তার চেয়ে বেশী শক্তিশালীই নয় অনেক বেশী ক্ষিপ্রও। এক হাতে ছায়ামূর্তির গলাটা ধরে রেখেই অন্য হাতে রিভলভার-ধরা হাতর ওপর একটা কারাটে চড় বসাল।
রিভলভারটা ছিটকে গেল হাত থেকে। ছায়ামূর্তি যন্ত্রণায় ও বলে আবার লোকটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল।
কিন্তু জোঁকের চেয়েও ছিনে লোকটার হাত আরো বজ্ৰবাঁধনে চেপে ধরল তাকে। ছায়ামূর্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
.
০৮.
সামন্ত মশাইয়ের তাঁবুতে কুন্দকুসুম চোখ মেলে চাইলেন। তার জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞানবয়সে এর আগে আর কখনো কোনো অবস্থাতেই তিনি জ্ঞান হারাননি। অজ্ঞান হওয়ার অভিজ্ঞতা তার জীবনে এই প্রথম। কারো সঙ্গে গায়ের জোরে হেরে ‘ওয়াও এই প্রথম।
প্রবল শীতের মধ্যে একটা লোক তার মুখে অনবরত জলের ঝাঁপটা দিচ্ছিল। কুন্দকুসুম জলদগম্ভীর স্বরে তাকে বললেন “আর না।”
তারপর উঠে বসলেন। লোকটা বিনীতভাবে একটা গামছা এগিয়ে দিল। তিনি মুখ মুছতে-মুছতে দেখলেন, সামনেই একটা ফোল্ডিং চেয়ারে সামমেশাই উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। চোখে চোখ পড়তেই বলে, “এখন একটু ভাল বোধ করছেন তো?”
কুন্দকুসুম নিজের গলায় হাত বোলালেন। ব্যথা। কোমরেও যেন কুমির কামড়ে ধরে আছে। কব্জিটাও বেশ কাবু। ঝিনঝিন করছে। কিন্তু সেই বলবান লোকটার রাক্ষুসে আলিঙ্গনে তার এতক্ষণে মরে লাশ হয়ে যাওয়ারই কথা। বেঁচে যে আছেন সেই ঢের। জলদগম্ভীর গলাতে বললেন, “বেশ ভাল বোধ করছি। এ-যাত্রায় মরছি না। মরলে আপনার পো হারকিউলিসটির ফাঁসি হত।”
সামন্তমশাই শশব্যতে বলে, “আগে একটু গরম দুধ খান। গায়ে বল হোক, তারপর সব কথা।”
তার ইশারায় মূহুর্তের মধ্যে একটা আধসেরি গ্লাস ভর্তি ঈষদুষ্ণ দুধ এসে গেল।
কুন্দকুসুম দুধটায় চুমুক দিয়ে বলেন, “বাঃ বেশ দুধ। তা এ নিশ্চয়ই গরুমোষের দুধ নয়।”
“কেন বলুন তো!”
“আপনার হারকিউলিসটির গায়ে যা জোর, তাতে মনে হয় সে হাতির। দুধ খায়। কিংবা বাঘের। আপনার সার্কাসে বাঘ আর হাতির তো অভাব নেই।”
সামন্ত বিনীতভাবে হাসে। তবে তার চাউনিতে উদ্বেগটা স্পষ্টই বোঝা যায়।
কুকুসুমের এই দুধটুকুর দরকার ছিল। চোঁ করে গ্লাস নামিয়ে রেখে বললেন, “বিনা নোটিসে কাল রাতে আপনাদের তাবুতে হানা দেওয়া আমার উচিত হয়নি এটা মানছি। আমার সার্চ ওয়ারেন্টও ছিল না।”
সামন্তমশাই গলা খাঁকারি দিয়ে বলে “আজ্ঞে একাট নোটিস দিয়ে এলে এই বিপদে পড়তেন না। অন্ধকারে আপনাকে চিনতে না পেরে চোর-ছ্যাচড় ভেবে আমাদের ওয়েটলিটার ছেলেটা ওই কাণ্ড করে ফেলেছে।“
কুন্দকুসুম একটা শ্বাস ফেলে বললেন ওর দোষ নেই। আমার আচরণটা চোরের মতোই হয়েছিল। আপনার পাহারাদাররা আমাকে ধরতে পারেনি, কিন্তু এই ছোঁকরা–কী নাম ছোঁকরার?”
“আজ্ঞে ভবতোষ। খুব ভাল ছেলে। ধার্মিক। মাঝরাতে উঠে নামধ্যান করে। কাল রাতেও তাই করছিল।”
“হ্যাঁ ভবতোষ। তা এই ভবতোষ তো দিব্যি কারাটেও জানে। যা একখানা ঝেড়েছিল আমার কব্জিতে। ভাল কথা, পিস্তলটা আছে তো?”