সুর চমৎকার করছে। হাঁ করলেই যেন গলা থেকে লোকজন ডেকে সাতটা পাখি বেরিয়ে চারদিকে উড়ে বেড়ায়।
উদ্ধববাবুর খুব ইচ্ছে, এবার একদিন লোকজন ডেকে সকলের সামনে গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দেন। কিন্তু মুশকিল হল, ওস্তাদ রাঘব ঘোষকে নিয়ে। উদ্ধববাবু রাঘবকে দুচোখে দেখতে পারেন না। সারা তল্লাটের লোক রাঘবকে বড় ওস্তাদ বলে কেন যে অত খাতির করে, তাও তার বোধের অগম্য।
সে যাই হোক, একদিন তিনি পুবের মাঠে এক শিশির ভোরে খুব আবেগ দিয়ে ভৈরবী ধরেছিলেন। চোখ বুজে গাইছেন। হঠাৎ একটা ফেঁপানির শব্দে গান থামিয়ে চোখ মেলে দেখেন, সামনেই রাঘব। ধুতির খুঁটে চোখ মুছে রাঘব বললেন, “এমন অনৈসর্গিক গান কখনো শুনিনি উকিলবাবু। তবে বলি এ গান সকলকে শোনানোর নয়। বিশেষ করে আপনার মক্কেলরা যদি শোনে, তবে তাদের ধারণা হবে, ইনি যখন এত ভাল গায়ক, তখন নিশ্চয়ই ভাল উকিল নন। কারণ প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে একজন মানুষ সাধারণত একটা বিষয়েই পারফেকশন লাভ করতে পারে।”
সেই থেকে উদ্ধববাবুর রাগ। ইচ্ছে করেই তিনি রোজ সকালে একবার রাঘব ঘোষের বাড়ির কাছাকাছি এসে খানিকক্ষণ গান করেন। অভদ্র লোকটা বুঝুক গান কাকে বলে। আজও উদ্ধববাবু পুবের মাঠে এসে রাঘবের বাড়ির দিকে মুখ করে চমৎকার তান লাগালেন ভৈরবীতে। গাইতে গাইতে তার নিজের পিঠ নিজেরই চাপড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল, শাশ।
আশ্চর্য, এই চোখ বুজে গাইতে গাইতেই হঠাৎ টের পেলেন, কে যেন সত্যিই তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে উঠল, শাববাশ।
উদ্ধববাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেন গবা পাগলা!
গবাও বেকুবের মতো চেয়ে-চেয়ে খানিকক্ষণ তাকে দেখে বলে উঠল, উদ্ধবকর্তার যে আবার গান-বাজনাও আসে, তা তো জানতাম না।”
উদ্ধববাবু একটু রাগের গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কী করছিস?”
গবা মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে কিছু করছিলাম না। কাল রাতে একটি লোক আমাকে এখানে খুন করে রেখে গেল। সেই থেকে মরে পড়ে ছিলাম। হঠাৎ এই সকালবেলায় আপনার গানে প্রাণ ফিরে এল। ওঃ, কী গান। মড়া পর্যন্ত উঠে বসে।”
“কী যা-তা বলছিস। কে তোকে মেরে রেখে গেল?”
“আজ্ঞে, তাকে তো চিনি না। কালো পোশাক পরা, মুখ ঢাকা। রাতে গিয়ে আমার ঘরে হাজির। বলল, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, অনেক টাকা দেব। রাজি না হলে প্রাণ যাবে।”
“বলিস কী?”
“আজ্ঞে, যা ঘটেছিল, বলছি, লোকটা বেশি ধানাই-পানাই না করে বলল, উদ্ধববাবু যে কাকাতুয়াটা কিনেছেন সেটা আসলে আমর, কিন্তু প্রমাণ করার উপায় নেই। আমি পাখিটাকে কিনতে চাই, কিন্তু উদ্ধববাবু বেচতে তেমন গা করছেন না। আইন দেখাচ্ছেন। আমার বড় আদরের কাকাতুয়া। তা তুমি যদি পাখিটা উদ্ধার করে দিতে পারো, তবে দুশো টাকা পাবে। নইলে…”
নইলে মেরে ফেলবে?”
“ওই নইলে কথাটায় আমার খটকা লাগল। পাখিটা ফেরত চায় কেন? অত গরজ কিসের? তা আমি সেই কথাটা জিজ্ঞেস করতেই লোকটা অ্যাই বড় একটা ভোজালি বের করে আর এক হাতে আমার টুটি ধরে টানতে টানতে মাঠের মধ্যে নিয়ে এল।”
“অ্যাটেমপট অব মার্ডার।” উদ্ধববাবুর ওকালতি-মাথা কাজ করছে। বিড় বিড় করে বললেন, “আ্যাটেমপট অব থেপট, থ্রেটেনিং অ্যাণ্ড অ্যাসাল্ট। তা লোকটা হঠাৎ ভোজালি বের করলই বা কেন? তুই কে কী বলেছিলি?”
“আজ্ঞে আমি তাকে বলেছিলাম, যুধিষ্ঠিরবাবু, আপনার পাখিটার জন্য এত গরজ কিসের?”
“যুধিষ্ঠিরবাবু! সে আবার কে?”
“আপনি চেনেন তাঁকে! বাচ্চাদের বাড়িতে পড়ান যে নতুন মাস্টারমশাই, তিনি।”
“বলিস কী! লোকটা কি সত্যিই যুধিষ্ঠির?”
“আজ্ঞে না। সত্যিকারের যুধিষ্ঠির ছিলেন ধর্মপুত্ত্বর। ইনি তিনি নন।”
“আরে দূর গাধা! আমি বলছি আমাদের যুধিষ্ঠির কিনা।”
“তাই বা বলি কী করে? তবে যুধিষ্ঠিরবাবু খুব পান আর জর্দা খান। আমিও রাত্রিবেলায় যমদূতটার মুখ থেকে সেই জর্দার গন্ধ পেয়েছেলাম। তাই”
“তারপর?”
“তারপর মাঠের মধ্যে এলে লোকটা ছোরা রেখে দু’হাতে আমার গলা টিপে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলল।”
“ফেলল? তবে বেঁচে রইলি কী করে?”
“কে বলল বেঁচে ছিলাম? সেই কখন থেকে মরে পড়ে আছি। সকালবেলা আপনার গান শুনে মরা দেহও জেগে উঠল। তাই ভাবলাম এমন যার গান, তাকে একটা শাবাশ জানিয়ে আসি। তা এসে দেখি আপনি স্বয়ং।”
উদ্ধববাবু গানের কথায় একটু গম্ভীর হলেন। বললেন, “গানের কথাটা অত বলার দরকার নেই।”
গবা অবাক হয়ে বলে, “বলেন কী? এমন উপকারী গান আমি জন্মে শুনিনি! আপনার গান শুনতে তেমন ভাল নয় বটে। মাথা ঘোরে, গা বমি বমি করে, ভিতরটা কেমন চমকে-চমকে ওঠে। কিন্তু মরা শরীরে প্রাণ ফিরে
আসে। পারবে রাঘব ঘোষ এমন গান গাইতে? রাঘবের তা-না-না কেবল লোক ভোলানোর জন্য। এখনো সা লাগাতে পারল না ঠিকমতো।”
একথায় উদ্ধব খুশি হলেন। বললেন “হুঁ।”
গবা বলল, “এ গান অবহেলার বস্তু নয় কবরখানার কাছে বসে গাইলে কবর খুঁড়ে অনেক মড়া জ্যান্ত হয়ে উঠে আসবে। শ্মশানের কাছে বসে গাইলে অনেক মড়া চিতা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়াদৌড়ি শুরু করবে।”
“আঃ! বাজে বকিস না তো! আমি ভাবছি কাকাতুয়াটার কথা। ওটাকে নিয়ে চারদিকে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। খোঁজ নিয়ে বের কর যে কাকাতুয়াটা আসলে কার! পাখীটা মাঝে মাঝে টাকার কথা বলে। মনে হয় কোনো গুপ্ত টাকার খোঁজ জানে, কিন্তু স্পষ্ট করে বলে না।”