“বলল?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিও ইয়ার্কির ভাব দেখিয়ে হেঁটে গিয়ে ভারার পয়লা বাঁশটায় উঠে পড়লাম। তারা দেখি তখনো মোচে তা দিচ্ছে আর ফিড়িক ফিড়িক করে হাসছে। আমি আর এক ধাপ উঠলাম। কেউ কিছু বলল না। রাজমিস্ত্রিরাও একমনে কাজ করে যাচ্ছে, আমার দিকে তাকাচ্ছে না। এক ধাপ দু ধাপ করে আমি একদম দেওয়ালের মাথায় পৌঁছে দেখি, তখনো সেপাই দুটো হাসছে আর মোচে তা দিচ্ছে।”
“বলিস কী?”
“যা হয়েছিল তাই বলছি। দেয়ালের মাথায় উঠে আমার মনে হল, কেননা কারণে জেলখানার কর্তৃপক্ষ আমাকে পালানোর সুয়োগ ইচ্ছে করেই দিচ্ছে। নইলে ততক্ষণে পাগলা ঘন্টি বেজে ওঠার কথা। বাজল না দেখে আমি দেয়ালের ওপর থেকে ঠাকুরের নাম করে বাইরের দিকে ঝাঁপ মারলাম। ট্রাপিজের খেলা দেখাতে গিয়ে অনেক উঁচু থেকে লাফ মারার অভ্যাস থাকায় হাড়গোড় ভাঙেনি। পড়েই কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে সামলে নিলাম। তারপর দৌড়।”
“তাহলে ফাঁসিটা হল কার?”
“তা আর খোঁজ নিইনি। পালিয়ে সোজা গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ব্যাগে জামাকাপড় আর কিছু টাকা নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম তক্ষুনি। বাড়ির লোককে বলে এলাম, যেন কাউকে কিছু না বলে। নিজের বাড়ি ছাড়া দুনিয়ায় আমার আর একটা মাত্র আশ্রয় আছে, তা হল এই সার্কাস। সার্কাসের জন্য জেলখানাতেও প্রাণটা কাদত। তাই ঘুরতে-ঘুরতে এসে হাজির হয়ে পড়েছি।”
“বেশ করেছিস। ভাল করেছিস। তবে কিনা…” সামন্তকে একটু চিন্তিত দেখায়।
“আমি এসে কি আপনাকে বিপদে ফেলাম সামন্তমশাই?”
সামন্ত গম্ভীর হয়ে বলে, “তুই আমার ছেলের মতো। ছেলে যদি বিপদে পড়ে আসে, তাহলে কি নিজের বিপদের চিন্তা থাকে রে গাধা! আমি ভাবছি তুই আজ খেলা দেখিয়ে ভুল করলি কি না। কুন্দ দারোগা আজ খেলা দেখতে এসেছিল। লোকটা খুবই বুদ্ধিমান। যে যদি গন্ধ পায় তবে তোর পক্ষে এ-জায়গা আর নিরাপদ নয়।”
“খেলা না দেখিয়ে যে হাঁফিয়ে পড়েছিলাম সামন্তমশাই। জেলখানায় তো ধরেই নিয়েছিলাম এই জীবনে আর সার্কাসের খেলা দেখানো হবে না। ঠাকুরের কাছে রোজ বলতাম, পরের জন্মে যেন আবার সার্কাসের খোলোয়াড় হতে পারি।”
সামন্ত মাথা নেড়ে, “এই সার্কাসকে তুই যে বুক দিয়ে ভালবাসিস তা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে? আমারও ইচ্ছে ছিল, মরার সময় এই সার্কাসের সব ভার তোকেই দিয়ে যাব। কিন্তু কাশিমের চরের সেই খুনটাই সব গোলমাল করে দিল।”
এবার গোবিন্দ গম্ভীর হয়ে বলল, “হরিহর পাড়ুই লোক খুব ভাল ছিল। কিন্তু তাকে যে আমি খুন করিনি, তা কি আপনি বিশ্বাস করেন?”
“করি। আমি জানি, তুই রাগী বটে, কিন্তু কখনো পিঁপড়েটাকেও মারতে চাস না। খুন তোরা দ্বারা হওয়ার নয়!”
* * * * * *
রাত নিশুত হলেও যে সবাই লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়ে তা নয়।
উদ্ধববাবুর চণ্ডীমণ্ডপের পাশে একটা ছোট্ট খুপরিতে খাঁটিয়ায় বিছানো খড়ের বিছানায় কুটকুটে এক কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামসে ঘুমোচ্ছিল গবা পাগলা। কিন্তু ঘুম তার খুব সজাগ। হঠাৎ চটকা ভেঙে সে উঠে বসল।
দুর্দান্ত হাড় কাঁপানো শীত পড়েছে আজকে। বাইরেটা কুয়াশা আর অন্ধকারে মাখা। খুপরিটার দরজা একটা কাঠের খিল দিয়ে আটকানো ছিল। সেটা খুলে
দরজা অনেকখানি ফাঁক হয়ে আছে, এটা অন্ধকারেও দেখতে পেল গবা। দেখে মৃদু একটু হাসল। তারপর বেশ হেঁকে বলে উঠল, “কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি খেকশিয়ালি পালায় ছুটি। পালা পালা পালা রে বাপ, নইলে হয়ে যাবি যে সাফ। পাগলা গবা ধরবে এসে টুটি!”
হয়তো আরো বলত গবা, কিন্তু তার আগেই দরজা নিঃশব্দে আর-একটু ফাঁক হল। একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল চৌকাঠে।
“গবা,” একটা ভারী গলার গম্ভীর আওয়াজ হল।
“ও।” গবা জবাব দেয়।
“তুই আসলে কে আমি জানি।”
গবা চোখ পিটপিট করতে থাকে।
লোকটা আবার বলে, “যদি বেঁচে থাকতে চাও তবে আমি যা বলছি ঠিক তাই করবে। পাগলামির ভান কোরো না। আমি জানি, তুমি কস্মিনকালেও পাগল নও।”
গবা নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি কে?”
.
০৭.
উদ্ধববাবু ওঠেন একেবারে কাক-ভোরে। তখনও আকাশে চাঁদ তারা থাকে। উঠে মুখ-হাত ধুয়ে ঠাকুর-পূজো সেরে বেড়াতে বেরোন। আর বেরিয়েই বেশ গলা ছেড়ে গান ধরেন।
আসল কথা হল, ছেলেবেলা থেকেই উদ্ধববাবুর খুব গাইয়ে হওয়ার শখ। শখটা খুব তীব্র, কিন্তু তাঁর গলায় সুর নেই। সুরটা এমন জিনিস যে, জন্ম থেকে যার আছে তার আছে, যার নেই, সে গলা সেধে মুখে রক্ত তুলে ফেললেও হবে না।
উদ্ধববাবুর গলা নেই। তবু সেই ছেলেবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে গলা সেধেছেন, গানের মাস্টারমশাই রেখেছেন, বড় বড় ওস্তাদের জলসায় গেছেন। তার ধারণা ছিল সাধনায় সব হয়। কিন্তু গানের সাধনা করতে গিয়ে লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি হচ্ছে দেখে বাবা খুব রাগারাগি করতেন। তারপর গান গাইতে বসলে পাড়া প্রতিবেশীরা কাসর-ঘন্টা বাজাত, শখে ফুঁ দিত। একবার নতুন এক বউদি তাকে বলেছিলেন, “উদ্ধব ঠাকুরপো, চার আনা পয়সা দেব, আজ আর গান গেও না।”
এইসব দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর উদ্ধববাবু আর প্রকাশ্যে গান গায় না। তবে তাঁর এখনো ধারণা, চেষ্টা করলে এবং লোকে বাগড়া না দিলে তার গলা একদিন খুলে যেত ঠিকই।
যেত কেন, গেছেই। প্রকাশ্যে গান না গাইলেও রোজ সকালে বেড়াতে বেরিয়ে শহরের নির্জন প্রান্তে এসে উদ্ধববাবু নিয়মিত গলা সাধেন। দীর্ঘদিনের এই গোপন সাধনার ফলে তিনি ইদানীং লক্ষ করছেন, তার গলায় সাতটা