মহেন্দ্ৰ ওপর থেকে ঝুঁকে বললেন, “কে উবে গেল পিসিমা? ব্রজবাসিনী ওপরের দিকে চেয়ে ডুকরে উঠে বললেন, “ওরে তোর পিসেমশাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কবে থেকে?
আজই সকাল থেকে।
মহেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললেন, “এখনও তো ভাল করে সকালটা হল না, নিরুদ্দেশ যে হল তা বুঝলে কী করে?
বুঝতে কিছু বাকি নেই রে।
পিসেমশাই তো সকালে উঠে রোজই জগিং করতে যান। হয়তো তাই গেছেন।
তাই যদি যাবে তো দু দুটো বন্দুকের বাক্স, অ্যাত বড় স্যুটকেস, তিন জোড়া বুটজুতো, তোষক বিছানা মশারি, দাড়ি কামানোর জিনিস এসব গেল কোথায়?
মহেন্দ্র খুব নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, “অ! তাই বলো! পিসেমশাই তো তাহলে কোনও ট্যুরে গেছেন।
ট্যুরে গেলেই হল? আমাকে না বলে যাবে–তার ঘাড়ে কটা মাথা?
হয়তো তোমাকে বললে যেতে দেবে না, তাই না বলেই গেছেন।
যেতে দেবো না সে তো সত্যি। কিন্তু তা বলে আমাকে না জানিয়ে যাবে এমন মানুষ সে নয়।
কখন গেল কিছু জানো?
না রে। রাতে তো খেয়েদেয়ে এসে দিব্যি লেপমুড়ি দিয়ে শুলো, নাকও ডাকতে লাগল। সকালে উঠে দেখি, জলজ্যান্ত মানুষটা কর্পূরের মতো উবে গেছে।
ও পিসি, সাধু হয়ে যায়নি তো? সংসারের জ্বালায় কত মানুষ সাধু হয়ে যায়।
সাধু কি সঙ্গে বন্দুক নিয়ে যায় রে হাঁদারাম? নাকি তাদের স্যুটকেস বা বুটজুতোরই দরকার হয়? তাদের তো কৌপীন, কমণ্ডলু আর কম্বল হলেই হল।
সকালে কি ঘরের দরজা খোলা অবস্থায় দেখেছিলে?
খোলা ছিল বলেই তো ভাবছি।
তবে আর ভাববার কিছু নেই। পিসেমশাই গভীর রাতে সাধু হয়ে চলে গেছেন। কিন্তু সদর দরজাটা খুলে রেখে গিয়েছিলেন বলে পরে কোনও চোর এসে বন্দুক, বাক্স, বিছানা সব চুরি করে নিয়ে গেছে।
ওরে না না, এ সেইসব কাণ্ড নয়। এ হল অশৈলী ব্যাপার। শূলপাণিকে যে নিয়েছে তোর পিসেমশাইকে সে-ই নিয়েছে। তাকে চিরকাল দেখে এসেছি, কোনও কালে আমাকে না বলে এক পাও কোথাও যায় না। তেমন মানুষই নয়। বাক্স, বিছানা, বন্দুক এত সব জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া কি একজন মানুষের কাজ, বল তো!
সেই কথাই তো বলছি, পিসেমশাই ঝাড়া হাতপায়েই গেছেন, বাকি জিনিসগুলো চোরে নিয়েছে। দাঁড়াও থানায় একটা খবর পাঠাচ্ছি।
থানায় খবর গেল, পুলিশও এল। তার আগে এল গা-শুন্ধু লোক।
নগেন দারোগা বলল, পরঞ্জয়বাবু রাশভারি সিরিয়াস মানুষ, এমন হঠকারিতা করবেন না, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কোনও কাজ করে বসার মানুষ নন। সুতরাং তার নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে অন্য পক্ষের হাত থাকা বিচিত্র নয়।
গদাই চাপা গলায় বলল, পরঞ্জয়বাবু অবশ্যই নিরুদ্দেশ হতে পারেন।
কেন বলো তো?
ইদানীং তাঁর ব্লাড কোলেস্টোরাল ভীষণ বেড়ে যাচ্ছিল।
ব্লাড কোলেস্টোরাল বাড়লে কেউ নিরুদ্দেশ হয় নাকি?
কিছু বলা যায় না।
নয়ন হাতি কপাল চাপড়ে খুব হাহাকার করতে লাগল। অত বড় একজন পালোয়ানকে যদি তুলে নিয়ে যেতে পেরে থাকে তাহলে আমাদের আর নিরাপত্তা কিসের? আমি ওকে ওস্তাদ বলে মানতাম, আমাকে একটা তিব্বতী প্যাঁচ শেখাবেন বলে কথা ছিল।
জটেশ্বর বলল, আমি আর গোপেশ্বর কিছু বললেই পবনবাবু রেগে ওঠেন। তবু সত্যি কথা না বলেও পারছি না, ইদানীং পরঞ্জয়বাবু প্রায়ই শূলপাণির বাড়িতে যাতায়াত করতেন। এমন কি গত শনিবার সন্ধের মুখে শ্মশানকালীর মন্দিরের চাতালে বসে দুজনকে গভীর পরামর্শ করতেও দেখেছি।
৬-১০. হরিপুরের নদীর ধারে
হরিপুরের নদীর ধারে সকালে বাজার বসেছে। হরিপুরের বাজারের বেশ নামডাক। তার ওপর আজ হাটবার হওয়ায় লোকে একেবারে লোকারণ্য।
গজানন হালুইকরের দোকানে বিখ্যাত সাড়ে সাত প্যাঁচের জিলিপি ভাজা হয়েছে। গন্ধে চারদিক মম, মানুষ ভেঙে পড়েছে দোকানের সামনে। আড়াই প্যাঁচের ফিনফিনে জিলিপি এ নয়। গজানন হাতের কায়দায় সাড়ে সাত প্যাঁচ এমন সুন্দর মিলিয়ে করে যে ছোট-বড় হওয়ার উপায় নেই।
জিলিপির লাইনে একটু পেছনের দিকে জগা আর পাগলু দাঁড়িয়ে। পাছে লোকে চিনতে পারে সেই ভয়ে দুজনেরই মুখ বাঁদুরে টুপিতে প্রায় ঢাকা। তার ওপর গামছা জড়িয়ে মুখ এমন আবডাল করেছে, যে চেনা লোকও চিনতে পারবে না।
জগা চারদিকে ভাঁটার মতো চোখে তাকাচ্ছিল, হঠাৎ চাপা গলায় বলল “ওই যে!”
পাগলু জগার মতো নয়, তার চোখ ভাঁটার মতো ঘোরে না, বরং সবসময়ে একটা ঘুসঘুস ভাব। বলল, “কোথায়?”
পেছনে বাঁ দিকে, পানের দোকানের আয়নায় গোঁফ চোমরাচ্ছে। গায়ে সবুজ জামা আর কালো পাতলুন।
পাগলু গম্ভীর গলায় বলল, “হুঁম।”
“দেখেছ?”
“দেখে নিয়েছি।”
“এখন কী করবে?”
“চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। আমরা যে দেখেছি তা বুঝতে দিসনি।”
“ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে আগেভাগেই বলে রাখছি, আমার কিন্তু গজাননের সাড়ে সাত প্যাঁচের জিলিপি খাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। সকালে এককাঁড়ি পান্তাভাত খেয়ে তার ওপর এক হাঁড়ি দই আর আঠারোটা সন্দেশ খেয়ে তবে এসেছি।”
পাগলু বলল, “পান্তাভাত খেয়েছিস সে বুঝলাম, কিন্তু দই আর সন্দেশটা সকালে কোথায় পেলি? লটারি মেরেছিস নাকি?”
জগা মাথা চুলকে বলে, “আর বলল কেন, কাল সুধীর ঘোযের মেয়ের বিয়ে ছিল, জোগানি সেজে ঢুকে পড়েছিলুম, যদি কিছু সরানো যায়। তা গয়নাগাটি পয়সাকড়ি কিছু তেমন জুটল না। শেষ অবধি দু’ হাঁড়ি দই আর দু’ বাক্স সন্দেশ নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”