তুমি কি বলতে চাও লোকটা বুজরুক?
তাও নয়। বুজরুকের অন্যকে ঠকানোর মতলব থাকে। শূলপাণির সে মতলব ছিল না। তবে সে যে পাগল তাতে সন্দেহ নেই। একবার আমার কাছে কতগুলো জিনিস দেখাতে এনেছিল।
কি জিনিস?
হরিপুরের হরেক কাঙ কয়েকটা কড়ি আর তামার পয়সা।
বলো কী? কাল তার ঘরে একটা কাঠের বাক্সে নাকি পাওয়া গিয়েছিল জিনিসগুলো। কিন্তু সেগুলো কে বা কারা সরিয়ে ফেলেছে।
সুজন এবার একটু চিন্তিত হয়ে বলল, সরিয়ে ফেলেছে? হ্যাঁ হে, দারোগাবাবুর নাকের ডগায় ঘটনা। তা তোমার জিনিসগুলো দেখে কী মনে হয়েছিল?
মাথা নেড়ে সুজন বলে, কিছুই নয়। সাধারণ তামার পয়সা, সাধারণ কডি। কোনও গুপ্তধন নয়।
আর কিছু হতে পারে কি?
কোনও সংকেত? তা আমি জানি না। মোট সাতটা কড়ি, আর সাতটা পয়সা ছিল। সংকেত হলেও তা ভেদ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে পয়সাগুলো বহু পুরনো। কোনও কালেকটারকে বেচলে কিছু টাকা পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তার বেশি কিছু নয়।
তোমার বাড়িতে তো একটা ল্যাবরেটারি আছে।
তা আছে। তবে গাঁ-গঞ্জে তো আর আধুনিক ল্যাব করা সম্ভব নয়। এ গাঁয়ে এখনও ইলেকট্রিকই আসেনি। সুতরাং ল্যাব বলতে যা বোঝায় তা নয়। ছোটোখাটো জিনিস বা এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে। কিন্তু কেন বলো তো?
ঐ কড়ি আর পয়সা ল্যাবরেটারিতে একটু পরীক্ষা করে দেখলে পারতে।
সুজন হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, আমি ওরকম কাজ করতে যাবো কেন বলো তো? কড়ি আর পয়সার মধ্যে কী এমন থাকতে পারে?
-ই যদি থাকবে তাহলে তা চুরি যাবে কেন? চিন্তিত সুজন বলে, সেটা একটা ভাবার মতো কথা। ওই সামান্য জিনিস নিয়ে কারও কোনও লাভ নেই। অন্তত কমন সেন্স সেই কথাই বলে। তবে সংকেত হলে আমার কিছু বলার নেই।
সাতটা পয়সা এবং সাতটা কড়ি-ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় মনে হয় না?
রহস্য মনে করতে চাইলে করতে পারো। বাধাটা দিচ্ছে কে?
.
০৫.
মহেন্দ্রচন্দ্রকে ইদানীং ভারি আলিস্যিতে পেয়েছে। আগে সারা তল্লাট ঘুরে বেড়াতেন, কখনও মোটরবাইকে, কখনও ঘোড়ায় চেপে, কখনও পায়ে হেঁটে, সাঁতার কাটতে ভালবাসতেন, ফুটবল বা টেনিস খেলাতেও খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু জমিদারি যাওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। এখন বাড়ি ছেড়ে যাননি, বেরোতে চান না, এমন কি বিছানা ছেড়ে নামতেও চান না বিশেষ।
এই শীতের সকালে আগে প্রাতঃভ্রমণে বেরোতেন। এখন লেপের তলায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে ওঠেন সেই বেলা আটটায়, তাও এমনিতে নয়, পিসিমার তাড়নায়।
পিসিমা ব্রজবাসিনী দেবীর চেহারা রোগামতো, ছোটোখাটো, কিন্তু দাপট সাঙ্ঘাতিক। তাঁর দাপটে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। তাঁর স্বামী মস্ত শিকারী এবং কুস্তিগীর পরঞ্জয় দত্ত এ বাড়িতে জড়োসড়ো হয়ে বাস করেন। দুই ছেলে বিজয় এবং দুর্জয় মায়ের ভয়ে একেবারে কেঁচো। মহেন্দ্রচন্দ্রের অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। এখন তাঁর বয়স পঞ্চাশের ওপর তবু পিসিমার নির্দেশ মেনেই তাঁকে চলতে হয়, মহেন্দ্রচন্দ্রের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদেরও একই অবস্থা।
ব্রজবাসিনীর দেবীর সবচেয়ে বড় দোষ তিনি মনে করেন সব মানুষেরই প্রচুর পরিমাণে খাওয়া উচিত। কেউ খেতে না চাইলে বা কম খেলেই তাঁর মাথা গরম হয়ে যায়। আর তখনই বকাবকি চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়। সুতরাং এ বাড়ির প্রত্যেকটি প্রাণীকৈ ব্ৰজবাসিনীকে সন্তুষ্ট রাখতে প্রাণপণে খেয়ে যেতে হয়। পরঞ্জয় দত্ত কুস্তিগীর মানুষ, খেতেও ভালবাসেন কিন্তু পঁয়ষট্টি বছর বয়সের পরেও যে সকালে তাঁকে উনিশটি করে পরোটা এবং তৎসহ চারখানা ডিম ও ছটা কলা খেতে হচ্ছে, এটাকে তিনি বাড়াবাড়ি মনে করেন। দুর্জয় আর বিজয়কে খেতে হয় বারোটা করে পরোটা আর তিনটে করে ডিম আর চারটে করে কলা। মহেন্দ্র চন্দ্রকে খেতে হয় পনেরোখানা পরোটা চারটে ডিম আর পাঁচটা কলা। সকালে এই বিপুল জলখাবারের পর দুপুরে আবার বিপুলতর আয়োজন। খেয়ে খেয়েই বোধহয় দুর্জয় আর বিজয়ের মাথামোটা হয়ে লেখাপড়া হল না। শরীর হল ঢোলের মতো। মহেন্দ্রচন্দ্রকে ঘোর আলসেমিতে ধরে ফেলল। পরঞ্জয় অবশ্য কুস্তিটুস্তি করে। মগুর ভেজে কোনওরকমে নিজেকে এখনও ফিট রেখেছেন কিন্তু এ জিনিস চললে যে রক্তচাপ এবং অন্যান্য অসুখ দেখা দেবে তাতে সন্দেহ নেই।
মহেন্দ্রচন্দ্র সকাল সাড়ে ছটায় ঘুম ভেঙে লেপের তলায় একটু এপাশ ওপাশ করছেন। কাল রাত্রেও তিনি নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখেছেন, মনটা ভাল নেই, পেটে বায়ু আর শরীরের চর্বি বেশ বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। নড়চড়া করতে আজকাল ইচ্ছে যায় না।
হঠাৎ তাঁর কানে এল পিসিমা ব্রজবাসিনী একতলায় প্রচণ্ড চেঁচামেচি করছেন। ব্রজবাসিনী হামেশাই চেঁচামেচি করে থাকেন, সেটা এমন কিছু অভিনব ব্যাপার নয়। কিন্তু আজকের চেঁচামেচির মধ্যে নতুন একটা খবর রয়েছে। ব্রজবাসিনী যেন চেঁচিয়ে কার নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা জানান দিচ্ছেন।
গাঁয়ে সদ্য একজন নিরুদ্দেশ হয়েছে এবং তার রেশ এখনও কাটেনি। এর মধ্যে আবার কে নিরুদ্দেশ হল তা বুঝতে না পেরে মহেন্দ্র আলস্য ত্যাগ করে লেপ ছেড়ে উঠলেন, গায়ে গরম চাঁদর জড়িয়ে ভেতর দিককার বারান্দায় এসে নিচের উঠোনে চেয়ে দেখলেন ব্রজবাসিনীকে ঘিরে দাসদাসী এবং আত্মীয়-স্বজনদের একটা ভিড়। ব্রজবাসিনী চিৎকার করে বলছেন, এ নিশ্চয়ই সেই ডাইনির কাণ্ড, জলজ্যান্ত লোকটা হঠাৎ উবে যায় কখনও?