নগেন দারোগা বলল, “ওসব আষাঢ়ে গল্প।”
সুধীর ঘোষ বলল, “আচ্ছা দারোগাবাবু, শূলপাণির কি ঘড়ি ছিল?”
“জানি না।” কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, “ছিল না। ছিল না!”
সুধীর বলল, “ঘড়িই যদি ছিল না তা হলে শূলপাণি কি করে রাত আটটা বাজলে টের পেত আর হেসে উঠত বলুন তো!”
নগেন দারোগা ঘেঁচিয়ে উঠে বলল, “তার আমি কী জানি?”
সুধীর ঘোষ বলল, “তাতেই তো প্রমাণ হল শূলপাণি একজন বৈজ্ঞানিকই ছিল।”
নগেন দারোগা চোখ কটমট করে বলল, “কী করে প্রমাণ হল?” সুধীর ঘোষ সকলের দিকে চেয়ে বলল, “হল কি না ভাইসব?”
সবাই বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, “হলই তো।”
নগেন দারোগা মাথা নেড়ে বলল, “ডিসগাস্টিং।”
.
০৩.
যত রাত বাড়ছে দুর্যোগও ততই বাড়ছে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি শুরু হওয়ায় শূলপাণির বাড়িতে জড়ো হওয়া লোকজন টকাটক সরে পড়তে লাগল। শেষ অবধি দারোগাবাবু, গদাই আর পবনকুমার ছাড়া কেউ রইল না।
গদাই শূলপাণির লণ্ঠনটা জ্বেলে মাঝখানে রাখল। তারপর তিনজন বসল পরামর্শ করতে।
নগেন বলল, পবনবাবু, আপনার অভিজ্ঞতা অনেক। শূলপাণির কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
পবনকুমার মাথা নেড়ে বলল, অনুমান করতে বলছেন? তাতে লাভ কী? শূলপাণিকে চিনি বটে, কিন্তু তার সম্পর্কে জানি কতটুকু? একটা লোকের স্বভাব-চরিত্র বা অতীতের জীবন খানিকটা জানলে অনুমান করা শক্ত হত না। কিন্তু শূলপাণি গাঁয়ের লোকই নয়। সরলা পিসি তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। সে গাঁয়ের কারো সঙ্গে বিশেষ মিশত না, আপন খেয়ালে নানা পাগলামি করে বেড়াত। এরকম লোক সম্পর্কে কিছু কি বলা যায়? ফলে সকালে পুলিশে খবর দিলে তারাই যা করার করবে।
নগেন দারোগা বলল, পুলিশে কাজ করেছি বলেই বলতে পারি, এই প্রত্যন্ত গাঁয়ে একটা পাগল নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে পুলিশ তেমন গুরুত্ব দেবে না। নিয়মমাফিক একটু খোঁজাখুঁজি করে ছেড়ে দেবে।
পবনকুমার বলল, তা জানি। তবু পুলিশকে জানিয়ে রাখা ভাল। আমরা তো আর হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব না। কাল সকালে জেলেপাড়ায় খবর দিলে তারা গাঁয়ের পুকুরগুলোতে জাল ফেলে দেখবে শূলপাণির লাশ পাওয়া যায় কি না।
যদি পাওয়া না যায়?
তাহলে ধরে নিতে হবে হয় সে আপন খেয়ালে কোথাও চলে গেছে, কিংবা কেউ তাকে গুম করেছে। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা খুবই ক্ষীণ। শূলপাণিকে গুম করে কারও কোনও লাভ হবে বলে তো মনে হয় না।
নগেন দারোগা বলল, গুপ্তধনের কথা কী যেন আপনিই বলছিলেন!
পবনকুমার হেসে বলে, ওটা কথার কথা। গোপেশ্বরকে একটু ভড়কে দেওয়ার জন্য বলা। আসলে সরলা পিসিকে আমি আমার ছেলেবেলা থেকে জানি। তাঁর গুপ্তধন থাকার কথাই নয়। সামান্য টাকা-পয়সা যা ছিল তা শূলপাণিকে দিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু সেই টাকার পরিমাণ সামান্যই হবে। আপনারা এত আগেই রগরগে ঘটনা কল্পনা করছেন কেন? শূলপাণি ফিরেও আসতে পারে।
গদাই নস্কর এতক্ষণ চুপচাপ বসে কথা শুনছিল। এবার বলল, কথাটা যুক্তিযুক্তই মনে হচ্ছে। কিন্তু পবনবাবু, শূলপাণি গাঁ ছেড়ে যাওয়ার লোক নয়। এই হরিহরপুর তার খুব পছন্দের জায়গা। তাছাড়া সে তার পোষা জীব জন্তুদেরও খুব ভালবাসত। এদের এরকমভাবে ফেলে সে কোথাও চলে যাওয়ার পাত্র নয়। শূলপাণি পাগল, আমিও মানছি। কিন্তু সে উন্মাদ পাগল নয়। ছিটিয়াল বলতে পারেন।
পবনকুমার একটু গম্ভীর হয়ে বলে, সেটাও ভাবছি। তবু কাল অবধি দেখা যাক। তার আগে ঘরটা সার্চ করলে কেমন হয়? নগেনবাবু তো একাজে পাকা।
নগেন চারদিকটায় একটু চোখ বুলিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, দেখার তেমন কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। পাগলা শূলপাণি রাজ্যের অকাজের জিনিস জড়ো করে রেখেছে দেখছি। তবু আপনি যখন বলছেন তখন দেখছি।
গদাই বলল, চলো, আমিও হাত লাগাই।
অবশেষে তিনজনই কাজে নেমে পড়ল। গদাইয়ের চৌকির নিচে একটা টিনের তোরঙ্গ পাওয়া গেল। তাতে পায়জামা, পুরনো কোট, কিছু কাপড়চোপড় ছাড়া একটা ম্যাজিক ওয়ার্ল্ড পাওয়া গেল। সরলাবুড়ির একটা আলমারি আর বাক্স খুলে রাজ্যের ন্যাকড়া, থান, জপের মালা, কাঁথা, পুরনো তেঁতুল, অজস্র কৌটোর মধ্যে ছাতা-পড়া মশলাপাতি ইত্যাদি বেরোলো। বাড়িতে আরও দুখানা ঘর আছে বটে, কিন্তু সেগুলো ব্যবহারযোগ্য নয়। ছাদ ফেটে গেছে, দেয়ালে ফাটল, রাজ্যের ধুলোময়লা জমে আছে।
গদাই ওপরের তাক থেকে একটা ছোটো কাঠের বাক্স টেনে নামাল। বাক্সটা পুরনো হলেও বেশ মজবুত। গায়ে কারুকাজ রয়েছে। বাক্সটা তালা দেওয়া।
গদাই তালাটা নেড়েচেড়ে বলল, এ তো বিলিতি তালা দেখছি। শূলপাণি এ তালা পেল কোথায়?
পবনকুমার ভ্রূ কুঁচকে বলল, এটা সরলা পিসির জিনিস নয়। আমি ছেলেবেলা থেকেই এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করি। সরলা পিসি নারকোলের নাড়, তিলুড়ি, পিঠে করে কত খাইয়েছে। তিনকুলে কেউ ছিল না তো, তাই আমাদের খুব ভালবাসত। তার জিনিসপত্র সব আমাদের চেনা। বাক্সটা খুলুন গদাইবাবু।
শূলপাণির জিনিস, খোলা কি ঠিক হবে?
নগেন বলল, ও হে, আমি তো প্রাক্তন দারোগা। আমার সামনেই তো খুলছে। বিপদে নিয়মো নাস্তি।
তাহলে দেখা যাক চাবি পাওয়া যায় কি না। চাবি পাওয়া গেল। শূলপাণির লণ্ডভণ্ড বিছানা হাতড়ে চাবিটা বের করে এনে ভারী বাক্সর ডালাটা খুলে ফেলল গদাই। তারপর অবাক হয়ে বলল, কিছুই তো নেই দেখছি। কয়েকটি কড়ি আর গোটা কয়েক তামার পয়সা।