তিনজনে এগোতে লাগল, বাঁয়ে একটা গলি পেয়ে একটু ঢুকতেই সামনে একটা ঝনাৎ করে শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলা আওয়াজ কৌন হ্যাঁয় রে?
ফের একটা গুলির শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্তনাদ।
জগা বলল, বাপ রে! এতো খুন-খারাপির কারবার!
পাগলু বলল, তাই দেখছি। তবু চল এগোই।
গলিটা ডানধারে বেঁকেছে এবং সেখানে একটা লোহার দরজা। এখানেও একটা লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে, তার হাতে একটা খোলা ভোজালি। অন্য হাতে টর্চ, টর্চ জ্বেলে দেখা গেল, এ লোকটার পেটে গুলি লেগেছে। জ্ঞান নেই, তারা আর সময় নষ্ট না করে দরজাটা ঠেলল, সেটা খুলেও গেল।
পাগলু বলল, সুজনবাবু যে আমাদের চেয়েও অনেক পাকা লোক দেখছি!
রামু বলল, হাঁ হাঁ, উস্তাদ লোক আছে, ইনকো পাস শিখনেসে আচ্ছা হোগা।
একটু সামনে সুজনবাবুরা একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সুজনবাবু বললেন, নিতাই, এটাই সাতকড়ির ঘর মনে হচ্ছে। দরজাটা কাঠের হলেও বেশ ভারী আর কারুকাজ করা।
তাই তো মনে হচ্ছে।
সুজনবাবু শূলপাণির দিকে চেয়ে বললেন, এবার বলো শূলপাণি, সাতকড়িকে কী বলতে হবে।
আমি জানি না।
তুমি সব জানো। সাতকড়ির সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ছিল, তুমি প্রায়ই এখানে আসতে সেটা তো নিজের মুখেই কবুল করেছে।
তা আসতাম। তবে সংকেত-টংকেত কিছু জানি না।
সে কথা বললে হবে কেন? সাতকড়িকে খোলানোর কৌশল তোমার ভালই জানা আছে।
আমাকে ছেড়ে দিন, আমি কিছু জানি না।
দেখ বাপু, তীরে এসে তরী ডুবলে তো আমার চলবে না। হাতে বেশি সময়ও নেই। টালবাহানা করলে আমাকে অন্য পন্থা নিতে হবে।
এই বলে সুজনবাবু পিস্তলটা একটু নাচালেন।
ভয় খেয়ে শূলপাণি বলল, আজ্ঞে বেবাক ভুলে গেছি।
কিছুই ভোলোনি বাপু। ভুলবার পাত্র তুমি নও। পাগল সেজে অনেকের চোখকে ফাঁকি দিয়েছে বটে, কিন্তু আমাকে পারোনি। হরিদাসপুরের আর্মারি লুটের ফেরারী আসামী তুমি। হরিপুরে ঘাপটি মেরে পাগল সেজে চোরাই অস্ত্রের চালানদার ছিলে। তোমার নামে হুলিয়া বেরিয়েছিল। যদি ভাল চাও তো যা বলছি করো। নইলে বিপদ আছে।
শূলপাণি মাথাটা ঝুঁকিয়ে একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনি যা শুনেছেন তার সব সত্যি নয়। আর্মারি লুটের দলে আমি ছিলাম বটে, কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় নয়। না থাকলে আমাকে খুন করা হত। আর অস্ত্র চালানের ব্যাপারেই আমার কী করার ছিল বলুন। আপনার স্যাঙাৎ নিতাই পালই তো ছিল নাটের গুরু! যাকগে এসব কথা, আমার জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে। নইলে সাতকড়িবাবুর কাছ থেকে ভাল রকম দাঁও মেরে কবেই বড়লোক হতে পারতুম। কিন্তু আমার জানা ছিল ও সম্পত্তির অন্য মালিক আছে। আমি তোক তো খারাপ নই সুজনবাবু।
না, তুমি গঙ্গাজলে ধোয়া তুলসীপাতা। বেশি সাধু সেজো না, তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিলে বোধহয় পাঁচ-দশ হাজার টাকা পুরস্কারও পাওয়া যাবে। যা বলছি যদি ঠিকঠাক করো তাহলে ছেড়ে তো দেবই, চাও তো বখরাও দিতে পারি।
আগে বলুন, সাতকড়িবাবুকে খুনটুন করবেন না।
আরে না হে, না। খুন করব কেন? খুনের অনেক ফ্যাঁকড়া। কাজটা গুছিয়ে নিতে পারলে ওসব করতে যায় কোন বোকারাম?
তাহলে পিস্তলটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিন।
একটু দোনোমোনো করে সুজনবাবু তাই করলেন। শূলপাণির দু’হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, সুতরাং সে পিস্তল দিয়ে কিছু করতে পারবে না।
শূলপাণি গলাখাঁকারি দিয়ে চোখ বন্ধ করল। তারপর বেশ সুরেলা গলায় গীতার একটি শ্লোক আবৃত্তি করতে লাগল, ন চ তিষ্ঠামি বৈকুণ্ঠে, যোগীনাং হৃদয়ে ন চ, মদ্ভা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদঃ…. ইত্যাদি। শ্লোক আবৃত্তি শেষ হলে শূলপাণি ডাকল, সাতকড়িবাবু, আমি শূলপাণি, দরজা খুলুন।
ঠিক তিনবার কথাটা বলে সে চুপ করল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর দরজার খিলটিল খোলার আওয়াজ হতে লাগল। একটু পরেই একটা দরজা ফাঁক হয়ে একজন বুড়ো মানুষ দেখা দিলেন। হাতে লণ্ঠন। এত লোক দেখে একটু তটস্থ হয়ে বললেন, এসব কী শূলপাণি? এরা কারা?
জবাবটা দিলেন সুজনবাবু, আমরা আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই, সময় বেশি নেই।
বুড়ো মানুষটি খুবই অবাক হয়ে বললেন, এই মাঝরাতে এমন কী কথা!
মাঝরাতে ছাড়া সুবিধে হচ্ছিল না মশাই, চলুন, ভেতরে চলুন।
সাতকড়িবাবুকে একরকম ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে সুজনবাবু ঢুকলেন, বিনা ভূমিকায় বললেন, সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সার রহস্যটা কী তা আমি জানি না। কিন্তু আমিই সেই পয়সা আর কড়ির মালিক। এবার আমার পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিন।
আপনি মালিক? কিসের মালিক! পয়সা বা কড়িই বা কিসের? আমি ওসব কিছু জানি না। আপনি কি ডাকাতি করতে ঢুকেছেন?
তাও বলতে পারেন। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আমি আঙুল বাঁকাতেও জানি।
হঠাৎ সাতকড়ির সাতানব্বই বছরের জীর্ণ শরীরটা টানটান হয়ে দাঁড়াল। গলার জোরও বাড়ল। সাতকড়িবাবু বললেন, বাপু হে, আমার বয়স সাতানব্বই হয়েছে, আমাকে ভয় দেখিও না। প্রাণের ভয় আমার নেই। অন্যায্য কিছু আমার কাছে আদায় করতে পারবে না। তবে জোর খাটালে খাটাতে পারো।
সুজনবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে শূলপাণির পকেট থেকে পিস্তলটা টেনে বের করে বললেন, তবে তাই হোক। আমাদের আর তর্ক করার সময় নেই। কাজ হাসিল করে কেটে পড়তে হবে।
সুজনের বোধহয় ইচ্ছে ছিল সাতকড়িবাবুকে ঘায়েল করে চাবির গোছাটা হাতিয়ে নিয়ে ঘরে রাখা সিন্দুক আর বাক্সগুলো খুলে যা পারেন হাতিয়ে নেবেন। কিন্তু পিস্তলটা তুলতে যেতেই হঠাৎ শূলপাণি তাঁর হাতে একখানা পেল্লায় লাথি কষিয়ে নিজেও পড়ে গেল। সুজনবাবুর হাত থেকে পিস্তলটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালে লেগে মেঝেয় পড়ল।