আচ্ছা ঢুকে হবেটা কী?
তা জানি না। আমার মন বলছে আমাদের ভেতরে যাওয়া একান্ত দরকার।
আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না। সবসময় আপনি অ্যাডভেঞ্চার খোঁজেন। কী আর করা যাবে। চলো হে মহেন্দ্র।
গাছে উঠতে খুব যে একটা অসুবিধে হল, তা নয়। তবে অন্ধকার বলে একটু সময় লাগছিল। তবে ডালটা বড় চমৎকার। দেয়াল পেরিয়ে একটা প্যারাবোলার মতো মাটির কাছাকাছি নেমে গেছে। পরঞ্জয় এই বয়সেও দারুণ চটপটে। ডাল বেয়ে সাতকড়ির বাগানে নামতে তাঁর তিন মিনিটও লাগল না। পবন আর মহেন্দ্রর সময় একটু বেশি লাগল।
অন্ধকার বাগানে নেমে তিনজন একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঝির ডাক শোনা যাচ্ছে। কাছেপিঠেই কোথাও
একঝাঁক শেয়াল ডাকল।
মহেন্দ্র বললেন, এবার?
পরঞ্জয় চাপা গলায় বললেন, চারদিকে মেলা গাছপালা রয়েছে। কিছু দেখার উপায় নেই। চলো, বাড়িটার দিকে এগোই।
পবন বললেন, কুকুর নেই তো!
থাকতে পারে। তবে কুকুর যদি তাড়া করে তবে ওদেরই আগে করবে। এসো।
চারদিকে দুর্ভেদ্য গাছপালা। বাগান না বলে জঙ্গল বলাই ভাল। পরঞ্জয় অভিজ্ঞ মানুষ। জঙ্গল ভেদ করে তিনিই আগে চললেন। পেছনে পবন আর মহেন্দ্র। খানিক দূর গিয়ে একটা পুকুরধারে পৌঁছালেন তারা। পুকুরের ওপাশে দুর্গের মতো বাড়ি।
পবন বললেন, ও বাবা, এ তো বিশাল বাড়ি। সাতকড়ি কোন ঘরে থাকে। তা বুঝব কী করে?
পরঞ্জয় বললেন, আগে থেকে অত ফ্যাঁকড়া তুলে লাভ কী? চলো দেখাই যাক।
পুকুরধার ধরে এগিয়ে গিয়ে তাঁরা বাড়ির পেছন দিকটায় পৌঁছলেন। গোটা বাড়িটাই অন্ধকার। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। দরজা জানালা সবই আঁট করে বন্ধ।
পবন বললেন, পরঞ্জয়বাবু, সুজন আর নিতাইকে তো দেখা যাচ্ছে না।
না, ওরাও এন্ট্রান্স খুঁজছে নিশ্চয়ই। এসো, আমরাও চারদিকটা ঘুরে দেখি।
ঘুরে দেখাও সোজা ব্যাপার নয়। বাড়ির চারদিকে মেলা ঝোঁপজঙ্গল এবং বড় বড় গাছ।
পরঞ্জয় টর্চ আর জ্বালছিলেন না। অন্ধকারেই ঠাহর করে করে এগোতে এগোতে হঠাৎ থেমে হাত তুললেন।
কেউ কোনও কথা বলল না। সামনেই একটা নিমগাছ। গাছটা দোতলা ছাড়িয়ে ছাদে গিয়ে পৌঁছেছে।
পরঞ্জয় একটু ইশারা করে গাছটা বেয়ে উঠতে লাগলেন।
কোথায় উঠছেন? পবন চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে।
ছাদে।
এখানে হেলানো ডাল নেই। খাড়া গাছে ওঠাও শক্ত। তাছাড়া মহেন্দ্র কাঠের বাক্সটা নিয়ে উঠতেও পারবেন না।
পরঞ্জয় উঠতে উঠতেই বললেন, তোমরা দাঁড়াও, আমি দেখে আসছি। মনে হয় এটা দিয়েই ওরা ছাদে উঠেছে। ছাদ দিয়ে বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করবে।
অগত্যা দুজনে নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। হনুমানকেও লজ্জা দেওয়ার মতো দক্ষতায় টারজানকেও হারিয়ে দেওয়ার মতো দ্রুতবেগে পরঞ্জয় দোতলা ছাড়িয়ে ছাদের কাছে উঠে গেলেন। তারপর আর তাঁকে দেখা গেল না।
মহেন্দ্র বললেন আশ্চর্য লোক বটে!
২৬-২৭. প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না
প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না। চারদিক নিস্ফূপ, শুধু ঝিঝি ডাকার শব্দ।
মহেন্দ্র উত্তর্ণ হয়ে ছিলেন, চাপা গলায় বললেন, ।ভেতরে কী হচ্ছে কে জানে। আমাদেরও কি ভেতরে যাওয়া উচিত?
পবন বললেন, ক্ষেপেছো? ওই খাড়া নিমগাছ বেয়ে ওঠা আমার কম্ম নয়। আমি বাঘ ভাল্লুককেও ডরাই না, কিন্তু খাড়া জায়গায় উঠতে আমার ভারি ভয়।
কিন্তু তা বলে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। পরঞ্জয়বাবুকে তো দেখলে, এই বয়সেও কেমন তরতর করে উঠে গেলেন।
আরে ওঁর কথা বাদ দাও। জঙ্গলে থেকে থেকে ওঁর একটা জংলি ভাব এসে গেছে। হয়তো হনুমান আর বাঁদরদের কাছে ট্রেনিং নেন। উনি পারলে কি আমাদেরও পারতে হবে?
একটু চেষ্টা করলে হত। আমার বেশ উদ্বেগ হচ্ছে।
আচমকা পবন হাত বাড়িয়ে মহেন্দ্রর মুখে চাপা দিয়ে বলল, চুপ! কে যেন আসছে। এসো, ওই ঝোঁপটার আড়ালে দাঁড়াই।
অন্ধকার তাঁদের চোখে সয়ে গেছে। তাই দেখতে তেমন অসুবিধে হচ্ছিল। পুকুরের ধার ধরে একজন নয়, পরপর তিনটে ভুতুড়ে মূর্তিকে সন্তর্পণে আসতে দেখা গেল। হাবভাব মোটেই ভাল নয়।
খুব চাপা গলায় পবন বললেন, অন্ধকারে ঠাহর করা মুশকিল। তবে মনে হচ্ছে এরা সেই তিন চোর।
কাদের কথা বলছো?
একজন হল জগা, অন্যজন পাগলু, তিন নম্বরটা ওদের এক স্যাঙাৎ। নাম জানি না।
মহেন্দ্র বললেন, হুঁ, জগা আর পাগলুকে চিনি। এরা চায় কী?
গুপ্তধন ছাড়া আর কী চাইবে বলো! কয়েক ঘণ্টা আগেই এদেরই তো অজ্ঞান করে ফেলে রেখে এসেছিলেন আমাদের সুজনবাবু। ওষুধটা হয়তো তেমন জোরালো ছিল না, তাই চটকা ভাঙতেই তিনজন হাজির হয়েছে এসে। ভালই হয়েছে। এদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
তার মানে?
শোনো, মানে না জেনে কি আর কথাটা তুলেছি? ভেতরে কী ঘটছে না ঘটছে আমরা জানি না, এদের তিনজনকে যদি ভেতরে পাঠানো যায় তাহলে পরঞ্জয়বাবুর একটু জোর হয়। এদের কাছে গাছ বেয়ে ছাদ ডিঙানো কোনও সমস্যা নয়। লোকবলও তো দরকার।
কিন্তু এরা যদি খুনোখুনি করে?
সে এলেম এদের নেই। ছাপোষা ছিচকে চোর সব। তুমি বাক্সটা নিয়ে আড়ালে থাকো, আমি গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা কই।
দেখো, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন না নষ্ট হয়।
হবে না। কোনও ভয় নেই, তাছাড়া সুজনের ওপর এদের রাগও আছে সেই রাগটাও আমাদের কাজে লাগবে।
পাগলু, জগা আর রামু ইতিউতি চাইতে চাইতে নিমগাছটার তলাতেই এসে দাঁড়াল। তাদের চোরের চোখ, বাড়ির ভেতরে ঢোকার এইটাই যে সোজা পথ তা লহমায় বুঝতে পেরেছে।