পরঞ্জয় বললেন, “সাতকড়ির বাড়িটা কোন দিকে?”
পবনকুমার বললেন, “গাঁয়ের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য বাড়িটাই তার হওয়ার কথা, চলুন, একটু ঘুরে দেখি।”
বেশি খুঁজতে হল না। গাঁয়ের এক প্রান্তে বেশ বড় পাঁচিলঘেরা একটা দোতলা বাড়ি দেখা গেল। ফটকে মোটা তালা ঝুলছে। ফটকের ভেতরে দারোয়ানের ঘরে দারোয়ানও আছে বলে মনে হল। তবে সে হয়তো ঘুমোচ্ছে।
পরঞ্জয় বললেন, “এবার?” মহেন্দ্র বললেন, “আমাদের একটু আড়ালে অপেক্ষা করতে হবে।”
“আড়ালে কেন?”
“কারণ, সুজনবাবু এবং নিতাই পালও এখন এ-গাঁয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তাঁদের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়াটা আমি এড়াতে চাই।”
“তা বটে।”
পবনকুমার বললেন, “চণ্ডীমণ্ডপটা পেরিয়ে এলাম। চলুন, সেখানেই ফিরে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিই। সকাল হোক তারপর দেখা যাবে।”
“সেটাই ভাল।”
চণ্ডীমণ্ডপটা ফাঁকা হাঁ-হাঁ করছে। বাঁধানো চাতালে তিনজন বসে জিরোতে লাগলেন। ঘোড়াগুলো ছাড়া পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোতে লাগল।
পরঞ্জয় হঠাৎ বললেন, “আচ্ছা, ওরা তো সোজা পথে গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবে না। যদি ওরা আজ রাতেই ও-বাড়িতে ঢুকে হামলা করে?”
পবনকুমার সোজা হয়ে বসে বললেন, “তাই তো?”
.
২৫.
তিনজনেই ফের উঠে পড়লেন।
পরঞ্জয় বললেন, বিশ্রাম নিয়ে ভাববেন না। আমরা বরং সাতকড়ির বাড়ির ধারে কাছে থানা গেড়ে থাকি।
পবনকুমার বললেন, সেইটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
মহেন্দ্র বলে উঠলেন, কিন্তু সুজনবাবু যে রকম মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাতে গুলিটুলি চালিয়ে দেবেন না তো!
পরঞ্জয় গম্ভীর হয়ে বললেন, অসম্ভব নয়। আমি যতদূর জানি সুজনবাবু একটা ল্যাবরেটারি বানানোর চেষ্টা করছেন। বিজ্ঞানের গবেষণাগার তৈরি করতে অনেক টাকা লাগে। সেই টাকার জন্যই উনি হন্যে হয়ে উঠেছেন।
পবনকুমার বললেন, কিসের ল্যাবরেটারি তা জানেন? বিজ্ঞানের তো অনেক শাখা।
পরঞ্জয় বললেন, উনি সেটা আমাকে ভেঙে বলেননি। আমেরিকায় উনি কী করতেন তাও কখনও আলোচনা করেননি।
মহেন্দ্র বললেন, যতদূর মনে হয় ওঁর বিষয় হল পদার্থবিদ্যা। উনি একজন পণ্ডিত ও গুণী মানুষ। তবু এই বেআইনি কাজটি কেন করতে যাচ্ছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
পবনকুমার বললেন, এ গাঁয়ের অপরাধীদের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ আছে। সেটাও খুব ভাল ব্যাপার নয়।
মহেন্দ্র বললেন, গন্ধটা থেকেই যাচ্ছে।
তিনজন হাঁটতে হাঁটতে সাতকড়ির বাড়ির ফটকের কাছে পৌঁছে গেলেন।
পরঞ্জয় বললেন, বাড়ির কম্পাউন্ডটা বিশাল বড়। তবু একটা চক্কর সেরে আসবে নাকি হে?
পবন বললেন, সেটা মন্দ প্রস্তাব নয়।
সাতকড়ির বাড়ির চারদিকে দশ ফুট উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপরে কাঁচ বসানো। তবু দেয়ালটা ডিঙোনো খুব একটা শক্ত কাজ নয়। কারণ, বাড়ির উত্তর আর পশ্চিমে দেয়ালের বাইরেই বিশাল আমবাগান। সেই আম বাগানের মেলা গাছের ডাল সাতকড়ির দেয়াল ডিঙিয়ে ভেতরে ঝুলে পড়েছে। গাছের ডাল বেয়ে দিব্যি ঢোকা যায়।
পরঞ্জয় সেই কথাটাই বললেন, চারদিকে দেয়াল থাকলে কী হবে, চোরের পক্ষে কোনও সমস্যাই নয়।
পবনকুমার বললেন, চোরেরা পারলেও সুজনবাবুর পক্ষে পারা মুশকিল। তাঁর বয়স সত্তরের ওপর।
পরঞ্জয় বললেন, আমার বয়সও সত্তরের কাছাকাছি। আমি জঙ্গলে যে ভাবে বাস করি তোমরা পারবে না। বয়সটা ফ্যাকটর নয়। আসল কথা হল প্র্যাকটিস। সুজনবাবু বেশ চটপটে এবং শক্তিমান মানুষ।
মহেন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, তা বটে।
পরঞ্জয় বললেন, সত্তর বছর বয়সেও সুজন ব্যায়াম করেন। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া আর পরিশ্রমের ফলে সুজন বেশ ফিট। কিন্তু এই বয়সে বেশি আকাঙ্ক্ষা করাটা ঠিক নয়। ওঁর উচ্চাশা বড্ড বেশি।
তাঁরা হাঁটছেন আগাছা এবং ঝোঁপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। নিকস্যি অন্ধকার চারদিকে। পরঞ্জয় মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছেন। তাঁর পেছনে পবন এবং মহেন্দ্র।
পবন কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ পরঞ্জয় থমকে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললেন, চুপ।
টর্চটা নিবিয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলো পরঞ্জয়। তারপর খুব চাপা গলায় বললেন, হুঁশিয়ার।
পবন বললেন, কী হল? সামথিং ইজ হ্যাঁপেনিং অ্যাহেড। শব্দ না করে এসো।
একটু থেমে তিনজন আবার সাবধানে এগোতে লাগলেন। দশ-বারো গজ এগিয়ে পরঞ্জয় আবার দাঁড়ালেন। টর্চটা জ্বেলে চারদিকটা খুঁটিয়ে দেখে বললেন, এখান দিয়েই ঢুকেছে।
পবন বললেন, একটু বুঝিয়ে বলুন।
সামনে একটা আমগাছের গায়ে টর্চ ফেলে পরঞ্জয় বললেন, এ গাছটায় ওঠা সবচেয়ে সহজ একখানা ডাল কেমন বাঁকা হয়ে উঠে গেছে দেখেছো? এই ডাল বেয়ে যে-কেউ দেয়াল পেরোতে পারে।
কেউ দেয়াল পেরিয়েছে বলে মনে হচ্ছে কেন আপনার?
আমি জঙ্গলে থাকি তো তাই আমার কান খুব সজাগ। সামান্য ডালপালা নাড়া বা পাতা খসে পড়ার শব্দও টের পাই। কেউ যে এই গাছ বেয়েই ভেতরে ঢুকেছে তাতে সন্দেহ নেই।
পরঞ্জয়বাবু টর্চ জ্বেলে দুজনকে দেখালেন, গাছের তলায় ঝোঁপঝাড়ে কিছু দলিত মথিত ভাব। আর হেলানো ডালটার গা থেকেও একটু বাকল খসার চিহ্ন।
পবন বললেন, তাহলে আমরা এখন কী করব?
পরঞ্জয় দৃঢ়স্বরে বললেন, আমাদেরও মহাজনপস্থা নিতে হবে।
সর্বনাশ! বুড়োবয়সে পড়েটড়ে যে হাড় ভাঙবে। প্রাণও যেতে পারে।
তুমি না বিপ্লবী ছিলে! ছোঃ, প্রাণের ভয় আবার একটা ভয় নাকি? আর বয়সের কথা তুললে বলতেই হয় যে, তোমরা আমার হাঁটুর বয়সী। বুড়ো হওয়ার আগেই বুড়িয়ে গেলে চলবে কেন?