“তাহলে চলো ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বেরোলে মুখোমুখি হওয়া যাবে।”
“তাই চলো।”
দু’জনে গিয়ে ফটকের দুধারে দাঁড়িয়ে রইলেন।
মিনিট পনরো বাদে পরঞ্জয় টর্চ নিবিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবলেন, তারপর ভাবতে-ভাবতেই এগিয়ে এলেন ফটকের দিকে।
পবনকুমার মৃদুস্বরে বললেন, “এই যে পরঞ্জয়বাবু!”
পরঞ্জয় এমন চমকে উঠলেন যে, বলার নয়। ধাঁ করে একটা পিস্তল বের করে প্রায় ট্রিগার টিপে দিয়েছিলেন, আর কি। কিন্তু মহেন্দ্র তার চেয়েও দ্রুতবেগে পরঞ্জয়ের কবজি চেপে ধরে পিস্তলের লকটা নামিয়ে দিয়ে বললেন, “করছেন কী?”
পরঞ্জয় অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আরে তোমরা! তোমরা এখানে কী করছ?”
পবন বলল, “সেই প্রশ্ন তো আমাদেরও, আপনি এখানে কী করছেন?”
পরঞ্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “কী করছি তা এক কথায় বলা মুশকিল। বলতে সময় লাগবে।”
“তার আগে বলুন, হঠাৎ নিরুদ্দেশ হলেন কেন।”
“নিজের ইচ্ছেয় হইনি।”
“তবে কি সুজনবাবুর ইচ্ছেয়?”
“অনেকটা তাই, তিনি আমাকে একটা পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমি সেটা গ্রহণ করেছি মাত্র।”
“এখন বাকি কথা বলুন।”
“এখানে দাঁড়িয়ে?”
“তার দরকার কী? আমরা সুজনবাবুর ঘরে গিয়েও বসতে পারি। উনি আজ রাতে আর ফিরবেন না।”
“ফিরবেন না? কেন কোথায় গেছেন সুজনবাবু?”
“গুপ্তধনের সন্ধানে।”
“সর্বনাশ! তা হলে তো–”
“ব্যস্ত হবেন না পরঞ্জয়বাবু। গুপ্তধন উদ্ধার করা অত সহজ নয়, কিন্তু আপনিই বা কেন গুপ্তধন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন?”
পরঞ্জয় একটু থতমত খেয়ে বললেন, “আসলে কী জানো, রহস্য ভেদ করতে আমি বড় ভালবাসি।”
পবনকুমার বললেন, “রহস্যভেদ করা ভাল, কিন্তু আগে জানা দরকার গুপ্তধন বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা আসলে কার প্রাপ্য। আপনি কি তা জানেন?”
“না, কার প্রাপ্য তোমরা জানো?”
“জানি। ওই বাক্সটা মহেন্দ্রর হেফাজত থেকে অনেকদিন আগে চুরি যায়।”
“বলো কী।”
“হ্যাঁ। ওই গুপ্তধনের আসল উত্তরাধিকারী মহেন্দ্র। ওর পিতামহ কিছু বিষয়সম্পত্তি বা টাকাপয়সা যাই হোক একজনের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। কী শর্তে তা অবশ্য আমাদের জানা নেই, সেটা উদ্ধার করা যাবে কি না তাও জানি না। কিন্তু উদ্ধার হলে তা মহেন্দ্ররই প্রাপ্য হয়।”
পরঞ্জয় যেন একটু ঘাবড়ে গেলেন। তারপর বললেন, “ওহে বাপু, অতশত আমার জানা ছিল না। আমি শূলপাণির কাছে শুনেছিলাম যে, ওই বাক্সে যা আছে তা এলেবেলে জিনিস নয়, একটা সংকেত আছে।”
“তাই কি দুজনে যড়যন্ত্র করছিলেন?”
“ষড়যন্ত্র! ষড়যন্ত্র হবে কেন? আমরা তো কোনও অন্যায় করিনি, সঙ্কেত উদ্ধারের চেষ্টা করতাম, যেমন লোকে ধাঁধাঁর সমাধান করে বা শব্দজব্দ মেলায়।
“গুপ্তধন যদি উদ্ধার হত তা হলে কী করতেন?”
“সত্যি কথা বলব?”
“বলুন না।”
“আমার ইচ্ছে ছিল কিছু মোটা টাকা পেলে মধ্যপ্রদেশে গিয়ে অনেকটা জমি বন্দোবস্ত করে নিয়ে একটা জঙ্গল বানাতাম।”
“জঙ্গল?”
“হ্যাঁ। এ-দেশের বনজঙ্গল যেভাবে সাফ হয়ে যাচ্ছে, তাতে মনটা বড় খারাপ হয়।”
পবন আর মহেন্দ্র দু’জনেই হাসল। পরঞ্জয় বললেন, “জঙ্গল বানিয়ে বাঘ টাঘ ছাড়তাম।”
“তারপর বাঘগুলোকে শিকার করতেন তো!”
“আরে না, শিকারের শখ যৌবনে ছিল, এখন অরণ্যের জীবদের জন্যে কষ্ট হয়। যাকগে, গুপ্তধন যখন মহেন্দ্রর তখন আর ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই।”
“কিন্তু আপনি অজ্ঞাতবাস ছেড়ে ফিরছেন কবে?”
“সংসার আর ভাল লাগে না। জঙ্গলে তো বেশ আছি, তাঁবুতে থাকি, সারাদিন ঘুরি, পাখির ডাক শুনি। বেশ কেটে যাচ্ছে, তোমরা আমাকে এরকমই থাকতে দাও।”
“তাই নয় থাকবেন।”
“এতদিন সুজন আমাকে পুষতেন, তাঁরই খরচে আছি, এবার থেকে। হয় নিজের খরচেই থাকব।”
“আমাদের জানা দরকার সুজন আপনাকে পুষতেন কেন?”
“সেটা প্রথমে বুঝতে পারিনি, ভেবেছি আমার প্রতি তাঁর একটা সিমপ্যাথি হয়েছে বলেই বুঝি প্রস্তাবটা দিয়েছেন, কিন্তু পরে বুঝতে পারি আমাকে ঘটনা থেকে দূরে রাখার জন্যেই এটা একটা চালাকি।”
“তাই ওঁর ঘরে আজ হানা দিয়েছিলেন?”
“অনেকটা তাই, আমি দেখতে এসেছিলাম বাক্সের সঙ্কেত ভেদ করে উনি কী পেয়েছেন।”
“তালা ভাঙলেন কেন?”
“সুজন নেই দেখে মাথায় বদ মতলব খেলে গেল। ভাবলাম সঙ্কেত ভেদ করে কোথাও কিছু লিখে রেখেছে কি না।”
“কিছু পেলেন?”
“না।”
“সঙ্কেত ভেদ করেও লাভ নেই, বাক্সটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ওটা সুজনের হেফাজত থেকে চুরি গেছে।”
পরঞ্জয় একটু হেসে বললেন, “চুরি আমিই করিয়েছি।”
“বলেন কী?”
“হ্যাঁ। জঙ্গলে যারা কাঠ বা পাতা আনতে যায় তাদের সঙ্গে আমার খুব ভাব। তাদের দিয়েই কাজটা করিয়েছি।”
“তা হলে কি বাক্সটা আপনার কাছে?”
“অবশ্যই, ওটা আমি মোটা প্লাস্টিকে জড়িয়ে মাটিতে পুঁতে রেখেছি।”
“সেটাই যে এখন দরকার!”
“তা হলে চলো, বের করে দিচ্ছি। ওয়ারিশান যখন পাওয়া গেছে তখন ও বস্তু রেখে আমার লাভ কী? মহেন্দ্র কিছু মনে কোরো না, আগে জানলে আমি লোভ করতাম না।”
মহেন্দ্র বললেন, “আমি কিছু মনে করিনি, তবে এ ব্যাপারে আপনার সাহায্য পেলে খুশি হব।”
“নিশ্চয়ই, সুজনবাবু লোকটি খুব সুবিধের নন। যদিও খুবই উচ্চশিক্ষিত বলে শুনি, কিন্তু মতলবটা মোটেই ভাল নয়। চলো, একটু তাড়াতাড়ি যাই, নইলে অঘটন ঘটতে পারে।”