“তোমারও ভয় নেই, তুমি অন্য গাঁয়ে থাকো, তোমাকে কেউ কিছু করবে না। তা ছাড়া শূলপাণিকে তো আমরা খারাপ রাখিনি। সে খাচ্ছে দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, আরামে আছে। শুধু ঘরে তালা দিয়ে রাখা হয় এই যা।”
“পরঞ্জয়বাবু কি কিছু সন্দেহ করবেন না?”
“পরঞ্জয়বাবুর কেসটা আলাদা, তাঁর সংসারে শান্তি ছিল না বলে তাঁকে আমি অজ্ঞাতবাসের পরামর্শ দিই। তিনি তো খুশি মনেই প্রস্তাবটা মেনে নিয়েছেন। আছেনও ভাল। জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প করে দিব্যি শিকার করছেন, নিজেই রান্না করে খাচ্ছেন। দেখাশোনা করার জন্য লোকও রাখা হয়েছে একজন।”
নিতাই বলল, “হ্যাঁ, এঁদের পেছনে আপনার টাকা আর পরিশ্রম বড় কম যায়নি। কিন্তু শেষ অবধি কী লাভ হবে সেটাই ভাববার বিষয়।”
“দ্যাখ নিতাই, জীবনটা এরকমই, সবসময়ে লাভ হবে এমন কথা নেই, ঝুঁকি নিতেই হয়। টাকা খরচ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যদি আন্দাজটা লেগে যায় তা হলে এই খরচটা সুদে-আসলে উশুল হয়ে যাবে।”
“কিন্তু সুজনবাবু, এখন প্রশ্ন হল, ওই সাতটা পয়সা আর সাতটা কড়ি ছাড়া শেষ রক্ষা হবে কি না।”
“দেখা যাক। আজ রাতেই আমাদের রওনা হতে হবে। কাল ভোরেই আমাদের কাজ।”
“ঠিক আছে। আমি তৈরি।”
জানালার বাইরে ঘাপটি মেরে থাকা ছায়ামূর্তির পাশে হঠাৎ আর একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়াল।
প্রথম ছায়ামূর্তি দ্বিতীয়জনের দিকে চেয়ে ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ থাকতে ইশারা করল।
ভেতরে সুজনবাবু তাঁর রিভলভারে গুলি ভরলেন, একখানা বাঁদুরে টুপিতে মুখমাথা প্রায় ঢেকে ফেললেন, হাতে দস্তানা গলালেন।
নিতাই পালও সোয়েটার পরল।
“তা হলে ‘দুর্গা’ বলে বেরিয়ে পড়া যাক সুজনবাবু।”
“হ্যাঁ চলো।”
দু’জনে বাতি নিভিয়ে দিয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
প্রথম ছায়ামূর্তি দ্বিতীয়জনের দিকে চেয়ে বলল, “কিছু বুঝলে?”
“আন্দাজ করছি।”
“নাটের গুরু হচ্ছে ওই সুজনবাবু।”
দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে সন্দেহও ছিল।”
পবনকুমার মৃদু স্বরে বলল, “তোমার বাড়ি থেকে কাঠের বাক্সটা কবে চুরি যায়?”
“অনেকদিন আগে।”
“বাক্সের রহস্য কিছু জানো?”
“খুব পরিষ্কারভাবে জানি না, তবে পিতামহের আমলের কোনও ঘটনা। মনে হয় কোনও একজন বিশেষ খাতকের কাছে আমাদের প্রভূত পরিমাণ পাওনা আছে। দাদু কোনও কারণে সরাসরি পাওনাগণ্ডার দলিল না করে এরকম একটা অদ্ভুত সাঙ্কেতিক ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। হয়তো রহস্য ভালবাসতেন বলেই।”
“তার মানে বাক্স যে পাবে এবং রহস্য যে ভেদ করতে পারবে পাওনাগণ্ডা সে-ই আদায় করতে পারবে?”
“হ্যাঁ।”
“আর না পারলে পাওনাগণ্ডা খাতকের দখলেই থেকে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“ভাল চাল দেখছি।”
“হ্যাঁ। আমার দাদু এসব ছোটখাটো রহস্য করতে ভালবাসতেন।”
“তার মানে তুমি ন্যায্য অধিকারী হয়েও পাওনাগণ্ডা আদায় করতে পারবে না?”
“তাই তো দাঁড়াচ্ছে।”
পবনকুমার একটু ভেবে বলল, “সুজনবাবু যদিও রহস্য ভেদ করতে পেরেছেন কিন্তু বাক্সটা ওঁর কাছে নেই। সুতরাং উনি সুবিধে করতে পারবেন না।”
“না।”
“কিন্তু সঙ্গে রিভলভার নিয়েছেন, খুন-খারাপি করবেন না তো!”
“লোকটাকে আমি সামান্যই চিনি। কীভাবে বলব?”
“উনি একটু গুণ্ডাপ্রকৃতির মানুষ। বয়স হওয়ায় গায়ের জোর কমলেও বুদ্ধি দিয়ে গুণ্ডামি করতে ছাড়েন না।”
“তাই তো দেখছি।”
পবনকুমার ভ্রূ কুঁচকে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “তোমাদের এখন পড়তি অবস্থা। পাওনাগণ্ডা আদায় হলে তোমার সুবিধে হত।”
“হ্যাঁ। প্রজাপালক হিসেবে এ-বংশের নাম ছিল, তুমি তো জানো। কিছু টাকা-পয়সা হাতে এলে সেই কাজটা করা যেত।”
“জানি, কিন্তু সুজনবাবুর সঙ্গে এঁটে ওঠা শক্ত। লোকটা মরিয়া হয়ে নেমেছে। শূলপাণি আর পরঞ্জয়বাবুকে গুম করার মতো কাজ যে করতে পারে সে সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়।”
“জানি, কিন্তু সজল সেই কাজটা কর নাম ছিল, তুমি তে
“বুঝেছি।”
“কিন্তু আমাদের একটা ভরসা আছে। বাক্সটা এখনও সুজনের হাতে নেই।”
“বাক্সটা কার কাছে আছে পবন?”
“সেটা জানলে তো কাজ হয়েই যেত।”
মহেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি আশা ছেড়েই দিয়েছি।”
“তা কেন ছাড়বে? ঠাণ্ডা মাথায় এসো দুজনেই একটু ভাবি।”
“তা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু ঘটনা যেমন দ্রুত এগোচ্ছে তাতে–”
“আরে, অত ভেঙে পোডো না। দেখাই যাক না।
.
২৩.
পবনকুমার আর মহেন্দ্র যখন স্থানত্যাগ করার উপক্রম করছে তখন হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে দু’জনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। শব্দটা বেশ জোরালোই, কে যেন সুজনের দরজার তালা ভাঙার চেষ্টা করছে।
ঝনাৎ-ঝনাৎ করে বারতিনেক শব্দ হল। তারপরই ঝড়াক করে দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকল একটি অন্ধকার মানুষ। অন্ধকার বলে তাকে দেখা গেল না ঠিকই, কিন্তু পবনকুমারের অভ্যস্ত চোখ দেখতে পেল লোকটা বেশ লম্বা-চওড়া।
একটা টর্চ জ্বেলে লোকটা চারদিকটা দেখতে লাগল। জিনিসপত্রও হাঁটকাল, বিশেষ করে টেবিলের ওপর কাগজপত্রগুলো, ড্রয়ার খুলে সব তছনছ করল কিছুক্ষণ।
পবনকুমার চাপা গলায় মহেন্দ্রকে বলল, “পরঞ্জয়বাবু।”
“অ্যাঁ! বলো কী!”
“চুপ।”
মহেন্দ্র চাপা গলায় বলল, “কী করছেন উনি?”
“কিছু খুঁজছেন?”
“কী খুঁজছেন?”
“তা কী করে বলব?”
“চলো ওঁকে ধরি।”
“ধরবে?”
“ক্ষতি কী?”
“অপ্রস্তুত হবেন হয়তো।”
“তা হোক না, আমাদেরও তো উনি অপ্রস্তুত কিছু কম করেননি।”