বোধহয় নিতাই পালকে নিয়ে এল। “চলো যাই পাগলুদাদা, দেখি লোকটা কী বলে।”
“চল।”
দরজায় ধাক্কা দেওয়ার বেশ কিছুক্ষণ বাদে দরজা খুললেন সুজনবাবু। গম্ভীর মুখে বললেন, “এখনও এক ঘণ্টা হয়নি। আরও পনেরো মিনিট বাকি আছে।”
জগা একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে আমাদের হাতে তো ঘড়ি নেই, তা ছাড়া খিদেও পেয়েছে মশাই।”
সুজনবাবু খুব কড়া চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “ঠিক আছে, ভেতরে এসো।”
জগা ভেতরে ঢুকে বলল, “তা মশাই, আপনার মাথায় কোনও মতলব এল, নাকি ঝুটমুট আমাদের হয়রান করছেন?”
সুজনবাবু গিয়ে চেয়ারে বসে বললেন, “আমি চা খাচ্ছিলাম। ইচ্ছে করলে তোমরাও খেতে পারো, চা খুব স্টিমুল্যান্ট।”
“কী আন্ট বললেন?”
“বলকারক জিনিস।”
“শুধু চা? ধুর মশাই আমার যে খিদে পেয়েছে।”
“ওঃ হ্যাঁ, সন্দেশ খাবে?”
“খুব খাব মশাই, আমাদের আবার জিজ্ঞেস করতে আছে? দিলেই খাই।”
সুজনবাবু একটা সন্দেশের বাক্স ভেতরের ঘর থেকে নিয়ে এলেন, বললেন, “খাও, অনেক আছে।”
তিন জনেই টপটপ করে কয়েকটা খেয়ে নিল। “আরও খাব মশাই?”
“খাও খাও, কোনও বাধা নেই।”
বাক্স একটু বাদেই ফাঁকা হয়ে গেল। সুজনবাবু বললেন “ওই কুঁজোয় জল আর পাশে গেলাস আছে। জলও খেতে পারো।”
তিনজনেই উঠে গিয়ে জল খেয়ে এল।
জগা পেটে হাত বুলিয়ে বলল, “আহা ভুড়ি ঠাণ্ডা না থাকলে মাথাটাও ঠাণ্ডা থাকে না কিনা, আহা, এখন বড় আনন্দ হচ্ছে।”
“হচ্ছে? বেশ বেশ!”
“তা কী ভাবলেন বলুন তো! নাকি বুদ্ধি দেওয়ার জন্য নিতাই পালকে আনতে হল?”
“নিতাই পাল! সে কেন আসবে?”
“এসেছে মশাই, নিজের চোখে দেখেছি।” সুজনবাবু একটু হেসে বললেন, “তোমার চোখ দেখছি বেশ শার্প।” হাই তুলে জগা বলল, “যে আজ্ঞে। চোরের চোখ বলে কথা।”
আরও দু’জনও হাই তুলল, বড্ড ঘুম পাচ্ছে তিনজনের।
জগা বলল, “মশাই সন্দেশে কি সিদ্ধি-টিদ্ধি কিছু মেশানো ছিল?”
“কেন বলো তো।”
“এত ঘুম পাচ্ছে কেন?”
“ঘুম পেলে ঘুমোও।”
সুজনবাবু একটু হাসলেন। তিনজনের ঘুমন্ত মাথা পর্যায়ক্রমে ঠাই ঠাঁই করে টেবিলে পড়ল হঠাৎ।
.
২২.
ঘরের বাইরে পেছনের আগাছার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে জানালার পাল্লার একটু ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরকার দৃশ্যটা দেখছিল আর-একজন। সুজনবাবু তিনটে চোরকে সন্দেশ খাওয়ালেন এবং তারপরই তিনজন প্রায় একই সঙ্গে সংজ্ঞা হারিয়ে টেবিলে মাথা দিয়ে পড়ে রইল।
সুজনবাবু পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত তিনজনের দিকে চেয়ে পরিতৃপ্তির হাসি হাসলেন, তারপর অনুচ্চ গলায় ডাকলেন, “নিতাই!”
ভেতরের ঘর থেকে নিতাই বেরিয়ে এল। চোখমুখে কিছুটা যেন আতঙ্কের ভাব, “সুজনবাবু, এরা মরে যায়নি তো!”
“আরে না, মরবে কেন? ঘণ্টা কয়েকের জন্য অজ্ঞান হয়ে গেছে মাত্র।”
“বাঁচা গেল।”
“বড় জ্বালাচ্ছিল। চোর বটে, কিন্তু বুদ্ধিমান চোর নয়। কাজ পণ্ড করে দিত।”
“কিন্তু কাজটাই বা কী করে হবে? সেই কড়ি আর পয়সা তো চুরি হয়ে গেছে।”
গম্ভীর হয়ে সুজনবাবু বললেন, “হুঁম, সেটাই ভাবিয়ে তুলল।”
“চোরদের তো আপনি দেখেছেন। চেনা ঠেকেনি?”
“না হে! আচমকা মাথায় মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছিল।”
“এরা কি এভাবেই পড়ে থাকবে?”
“না, জ্ঞান ফিরলে গোলমাল করতে পারে। আমার ঘরে এভাবে এদের পড়ে থাকাটাও ভাল দেখাবে না।”
“তা হলে?”
“একটু পরিশ্রম করতে হবে।”
“তিনজনকে অন্য কোথাও পাচার করবেন?”
“ঠিক ধরেছ, তবে বেশি দূরে নয়। রাস্তার ওপাশে একটা জংলা জায়গা আছে। ধরাধরি করে সেখানে নিয়ে গিয়ে রেখে আসতে হবে।”
“কিন্তু তাতে কি প্রতিক্রিয়া এড়াতে পারবেন?”
“সে পরে দেখা যাবে।”
“এরা জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আপনার ওপর প্রতিশোধ নেবে না তো?”
“তত এলেম এদের নেই। অন্তত পাগলু সেরকম নয়। তবে ওই জগাটা একটু ঢ্যাঁটা আছে। আর রামপ্রসাদ এ-গাঁয়ের লোক নয়। কাজেই ওকে নিয়ে চিন্তা নেই।”
“তা হলে চলুন, কাজটা সেরেই ফেলা যাক। দেরি করলে কে কখন এসে পড়বে।”
এরপর দুজন ধরাধরি করে একে-একে তিনজনকে নিয়ে আগাছার জঙ্গলে ফেলে এল। তারপর দুজনে মুখোমুখি বসল।
নিতাই বলল, “এরপর প্ল্যানটা কী?
“এটা তো জানা গেছে যে, গগনচাঁদের হাটই সাতপয়সার হাট। আর সাতকড়ি নামে একশো বছরের কাছাকাছি বয়সি একটা লোকও সেখানে থাকে। সুতরাং আমাদের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে।”
“কাজ কোনদিকে এগোল তা তো বুঝতে পারছি না।”
“কেন বলো তো?”
“গোটাটাই তো অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া।”
সুজনবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “হয়তো তাই। কিন্তু কে বলতে পারে?”
“সুজনবাবু, সামান্য একটা অনুমানের ওপর নির্ভর করে শূলপাণিকে সরিয়ে ফেলা বা পরঞ্জয়বাবুকে অন্যত্র নিয়ে রাখাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়নি কি?”
সুজন থমথমে মুখে বলে, “তুমি জানো না, শূলপাণির মুখচোখ দেখে আমার মনে হয়েছিল, সেই ওই বাক্সের রহস্য প্রায় ভেদ করে ফেলেছে। পাগল ছাগল যাই হোক, শূলপাণিকে ছেড়ে রাখা বিপজ্জনক ছিল, আর পরঞ্জয় শূলপাণির সঙ্গে মাখামাখি শুরু করায় ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।”
“বিপদ এখনও আছে। শূলপাণি ছাড়া পেয়ে গাঁয়ের লোককে ঘটনাটা বললে কী হবে কে জানে!”
“ভয়ের কিছু নেই। শূলপাণিকে গুম করেছে বাইরের ভাড়াটে লোক। আমরা যে তার পেছনে আছি, তা তো সে জানে না।”
“আপনাকে ধরা যাবে না ঠিকই, কিন্তু আমাকে তো শূলপাণি দেখেছে।”