জগা একটু উজ্জ্বল হয়ে বলে, একটা বড় কাজ হাতে আছে, বুঝলে রামপ্রসাদদাদা? কাজটা করতে পারলে নগদ বিশ হাজার টাকা।
কী কাম রে জগুয়া?
একজন বুড়ো মানুষকে খুন করতে হবে।
আরে রাম রাম! খুন উন খারাপ কাজ আছে। চোর কা ভি কুছ ধরম হ্যাঁয় রে বুরবক। খুন কাহে করবি?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জগা বলল, করতে আমারও মন চাইছে না, বুঝলে? কিন্তু দিনু গুণ্ডা কি ছাড়বে ভেবেছো? আগাম ধরিয়ে দিয়ে গেছে, কাজটা করতে না পারলে ব্যাটা আমার মুণ্ডু না নামিয়ে দেয়।
ছিয়া, ছিয়া, খুন খারাবি কি কোই মরদকা কাম আছে রে?
কী করব বলো তো! দিনু ব্যাটা কবে এসে হাজির হয় তার ঠিক নেই।
তু হিয়াঁসে ভাগ যা জগুয়া।
ভেগে কোথায় যাবো? কোন চুলোয় কে ঠাঁই দেবে আমায় বলো তো!
তু হামার মুলুকমে চল।
গিয়ে?
ভেঁস চরাবি, গাই দেখবি, খেতি কা কাম করবি, আউর রাত মে থোড়াবহৎ চোরিওরি ভি করবি, ভেঁসকা দুধ পিয়ে অ্যাইসা তাকৎ হোবে যে দশ-বিশ জোয়ানের সঙ্গে লড়াই করতে পারবি।
আমাকে চাকর খাটাতে চাও নাকি?
আরে নেহি নেহি চাকর থোড়াই বলবি। আধা বখরা হোবে।
মাথা নেড়ে জগা বলে, না গো রামপ্রসাদদাদা, যে আমি পারব না। হরিপুর ছেড়ে কোথাও গিয়ে আমার মন টিকবে না।
দুজনে খাওয়া শেষ করে উঠে সবে একটু চাটাই পেতে গড়িয়েছে হঠাৎ বাইরে হুংকার শোনা গেল, জগা! অ্যাই জগা!
জগা ধড়মড় করে উঠে বলল, ওরে বাপ!
রামপ্রসাদ নিমীলিত চোখে চেয়ে বলল, কৌন চিল্লাচ্ছে রে?
সাক্ষাৎ যম। ওই তো দিনুগুণ্ডা।
রামপ্রসাদ মিটমিট করে চেয়ে বলল, কেমন গুণ্ডা?
বহৎ গুণ্ডা।
বাইরে ফের হাঁক শোনা গেল, জগা! অ্যাই জগা! দরজা খোল বলছি।
জগা উঠে দরজাটা খুলে দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, আরে দিনুদাদা যে!
দিনু তার পেল্লায় চেহারাটা নিয়ে দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে বলল, আজ রাতেই কাজ সারতে হবে। আর সময় নেই।
আজ রাতে! কিন্তু আজ যে আমার একাদশী! এই দিনটায় অন্ন ছুঁই না যে।
দিনু তার ঘাড়টা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আজ আবার কোন পঞ্জিকার একাদশী রে বদমাশ? আমাকে একাদশী চেনাচ্ছিস?
ঝাঁকুনির চোটে চোখে সর্ষেফুল দেখে জগা চিঁ চিঁ করে বলল, আহা ছাড়ো ছাড়ো দিনুদাদা, তোমার মামার বদলে আমিই যে কেঁসে যাবো!
তোর ঘরে ওটা কে রে?
ওঃ উনি হচ্ছেন রামপ্রসাদ সিং, ভুসওয়ালের দারোগা।
দারোগা!
আজ্ঞে, ছদ্মবেশে রোঁদে বেরিয়েছেন।
শুনে দিনুগুণ্ডা কোমরে হাত দিয়ে এমন হাঃ হাঃ করে অট্টহাস্য করল যে বাইরে কাকেরা ভয় খেয়ে কা-কা করতে লাগল।
দারোগা! বটে! অ্যাই রামপ্রসাদ, উঠে আয় তো দেখি, আয় এদিকে।
রামপ্রসাদ তাড়াতাড়ি উঠে হাতজোড় করে বলল, রামরাম বাবুজী!
তুই নাকি দারোগা? রামপ্রসাদ হাতজোড় করেই বলল, নেহি মালিক, জগা ঝুট বলছে।
তাই বল! কাল যখন সরলাবুড়ির বাড়িতে ঢুকেছিলি তখন এই শর্মার হাতে পড়ে তো চিঁ চিঁ করছিলি, ছিচকে চোর কোথাকার!
জী হজৌর! ছোটামোটা চোর আছে মালিক।
এ গাঁয়ে এখনও ঘুরঘুর করছিস, তোর তো খুব সাহস! কাল যে তোকে নাকে খৎ দেওয়ালাম, তুই যে বললি রাতেই এ গাঁ ছেড়ে চলে যাবি!
উ বাত তো ঠিক আছে মালিক, কাল আপনার ঘুত্সা খেয়ে হাত পাওমে দরদ হচ্ছিল, থোড়া আরাম করিয়ে নিলাম। আজ চলিয়ে যাবো মালিক।
দিনু ঘরে ঢুকে চারদিকে চেয়ে দেখে বলল, এই ঘরে থাকিস নাকি রে জগা?
আজ্ঞে!
ছোঃ। বড্ড নিচু নজর তোর। এভাবে কেউ থাকে?
আজ্ঞে, অবস্থাটা খারাপই যাচ্ছে।
কাজটা করে ফেল, তোর ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে।
আজ্ঞে।
কী করতে হবে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ভাল করে শোন। ভুলভাল হলে বিপদ আছে।
আজ্ঞে বলুন।
ঠিক রাত আটটায় বেরোবি। মনে থাকবে?
যে আজ্ঞে।
গাঁ থেকে উত্তরে তিন ক্রোশ গেলে পঞ্চসায়রের জঙ্গল পড়বে, চিনিস?
চেনা চেনা ঠেকছে।
মারব গাঁট্টা। পঞ্চসায়রের জঙ্গল চেনে না এমন লোক কে আছে এখানে?
আজ্ঞে চিনি।
পঞ্চসায়রের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ক্রোশটাক গেলে রায়দিঘি।
আজ্ঞে।
রায়দিঘি থেকে ডানহাতি দক্ষিণের রাস্তা ধরে নাক বরাবর গেলে একটা হাট দেখতে পাবি।
হাট?
লোকে বলে ওটা গগনচাঁদের হাট।
মনে থাকবে।
আগে জায়গাটার নাম ছিল সাতপয়সার হাট।
অ্যাঁ।
চমকে উঠলি যে বড়?
জগা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আজ্ঞে ও কিছু নয়।
সাতপয়সার হাট বহু পুরনো জায়গা। দেখবি সব পুরনো আমলের বাড়ি-ঘর আর মন্দির-টন্দির আছে। জায়গাটা খুবই অখাদ্য। মশামাছি আর জোঁকের খুবই উপদ্রব।
যে আজ্ঞে।
সেখানে বুড়ো শিবমন্দিরের পেছনে একটা পাঁচশো বছরের পুরনো বাড়ি দেখতে পাবি।
যে আজ্ঞে।
সেই বাড়িতেই আমার মামা থাকে। সাতানব্বই বছর বয়স। বুঝলি?
আজ্ঞে জলের মতো।
মামার নাম সাতকড়ি গায়েন।
অ্যাঁ!
চমকে উঠলি যে বড়?
আজ্ঞে না, একটা মশা কামড়াল গালে, তাই।
ওই সাতকড়ি গায়েনই হল আমার শত্রুর। বুঝলি?
জলের মতো।
কাজটা খুব সোজা নয়। বরং বেশ কঠিন কাজই বলতে হবে।
যে আজ্ঞে।
মামার চারদিকে বেশ কঠিন পাহারা আছে।
ও বাবা, পাহারা থাকলে কী করব?
তুই বলবি সাতকড়ি গায়েনের কাছে তোর জমি বাঁধা আছে, তুই টাকা দিয়ে ছাড়াতে গেছিস।
বিশ্বাস করবে কথাটা?
খুব করবে।
দিনু পকেট থেকে একখানা তুলোট কাগজের টুকরো বের করে জগার হাতে দিয়ে বলল, এ কাগজটা দেখালেই তোকে পথ ছেড়ে দেবে।
তারপর কী করব?
সাতকড়ি গায়েন নিজের কাজ নিজেই করে। পাওনা গণ্ডার ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করে না। সামনে হাজির হতে পারলে আর চিন্তা কিসের? একখানা দোধার ছোরা রেখে যাচ্ছি। ছোরাটা সোজা বুকে বসিয়ে দিবি।