রামপ্রসাদ ফিরে তাকিয়ে জগাকে বসা দেখে চাপা গলায় বলল, “বসিয়ে আছিস কাহে রে? ভাগবি তো!”
জগা চাপা গলায় বলে, “ডাকছে যে!”
“সো হামি শুনিয়েছি। ঘরে ডেকে লিয়ে পিটাই করবে।”
“আরে না, না। বুড়ি একা একটা ঘরে থাকে।”
জানালা খুলে শীতলালক্ষ্মী দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ের গাঁটে ব্যথা হয়ে গেল বাপ। কখন থেকে একটা চোরের জন্য হা পিত্যেশ করে চেয়ে আছি। তা চোরেরও কি আজকাল আকাল পড়ল? আয় বাছারা, ঘরে আয়, ভয় নেই, লোকজন ডাকব না।”
বুড়ি দরজা খুলে লণ্ঠন হাতে দাঁড়াল।
দু’জন গুটিগুটি এগোতেই এক গাল হেসে বলল, “আহা রে, ভিজে যে একা হয়েছিস! আয়, গামছা দিচ্ছি, গা-মাথা মুছে বোস।”
হতভম্ব রামপ্রসাদ জগার দিকে চেয়ে বলে, “এ বুড়িয়া পাগলি আছে নাকি রে?”
“আরে না। চলোই না মজাটা দেখি, আমাদের রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে। যাঁহা বাহান্ন, তাঁহা তিপ্পান্ন।”
“ও বাত তো ঠিক আছে।”
ঘরে ঢুকতেই শীতলালক্ষ্মী আহ্লাদে ডগমগ হয়ে বললেন, “বাঃ বাঃ একটা চোর চেয়েছিলাম, ভগবান একেবারে একজোড়া পাঠিয়ে দিয়েছেন। তা বোস বাছারা, ঘন দুধ আছে, চিঁড়ে আছে, মর্তমান কলা আছে, ফেনী বাতাসা আছে, একটু ফলার করবি?”
“এ জগুয়া, ফল্লার কী চিজ আছে রে?”
“খুব ভাল জিনিস। বসে যাও।”
শীতলালক্ষ্মী দুটো আসন পেতে দিলেন মেঝেতে। তারপর দুটো জাম বাটিতে ঘন দুধ, অনেক চিঁড়ে, কলা আর বাতাসা দিয়ে বললেন, “খা বাছারা, আগে পেট ভরে খা, তারপর কাজের কথা হবেখন।”
.
১৭.
বহুকাল এমন খাবার খায়নি দুজনে। সরে ভরা ঘন দুধ, মর্তমান কলা, বাতাসা আর চিড়ে যে কী অমৃত তা বলে শেষ করা যায় না। শীতলালক্ষ্মী একেবারে মুক্তহস্ত হয়ে খাওয়াচ্ছেন। ফলে দুজনেরই দেদার খেয়ে পেট একেবারে টাঁই টাঁই হয়ে গেল।
শীতলালক্ষ্মী দুঃখ করে বললেন, আহা রে বাছারা, কতকাল বুঝি পেট ভরে খাসনি, তা কেমন চোর তোরা যে ভরাপেট খাওয়া জোটে না?
জগা করুণ গলায় বলে, ঠাকুমা, আমি খুবই ছিচকে আর ছোটোখাটো চোর, দিন চলে না।
শীতলালক্ষ্মী রামপ্রসাদের দিকে চেয়ে বললেন, আর তুই! তুই কেমন চোর রে বাবা?
রামপ্রসাদ খুবই লজ্জার সঙ্গে মাথা নামিয়ে বলল, আমি তো বড়া চোর আছি বুড়িমা। হামার ঘর মে ছোটো ভেঁস, তিনগো গাই, চার বকরি, সবকুছ আছে।
তা বাবা, তোরা বড় চোর আর ছোটো চোর দুটিতে মিলে আমার একটা কাজ উদ্ধার করে দিবি?
হাঁ হাঁ, কিঁউ নেহি? বোলেন বুড়িমা, যো কাজ বলবেন করিয়ে দিব।
জগা বলল, আজ্ঞে শক্ত কাজ হলে আমি কি আর পেরে উঠব ঠাকুমা? ফলার খেয়ে যে নিজেকেই টেনে দাঁড় করাতে পারছি না!
একগাল হেসে শীতলালক্ষ্মী বললেন, ওরে, তোদের দেখছি মরা পেট। এটুকু আর কী খেলি বাছা? আমার দাদাশ্বশুর আস্ত পাঁটার মাংস খেয়ে উঠে আস্ত কাঁটাল দিয়ে দুসের দুধের ক্ষীর খেতেন। তবে তাঁর সেঁকুর উঠত। আর কী ঢেঁকুরই উঠত বাপ, যেন বাঘ-সিংহী ডেকে উঠল। আমার শ্বশুরমশাইয়ের কথা শুনবি? আস্ত একথালা বিশসেরী কাতলা মাছের লেজ থেকে মুড়ো অবধি সাপটে খেতেন। তার পর এক হাঁড়ি দই আর পঞ্চাশটা রাজভোগ তাঁকে কতবার খেতে দেখেছি।
রামপ্রসাদ হাতজোড় করে বলল, উ সব দেওতা আছেন। আমি লোগ ছোটামোটা আদমি আছে বুড়িমা। যদি আউর খিলাবেন তো হামার দম নিকলে যাবে।
জগাও করুণ গলায় বলল, আজ আর নয় ঠাকুমা। অর্ধেকটা বাকি থাক, কাল আবার হবে খন।
আচ্ছা বাবারা, তোদের আর খেতে হবে না, তা বলি বাছারা, আমার একটা ছোটো কাজ করে দিবি?
আজ্ঞে বলে ফেলুন।
কাজ খুব সোজা, তোদের গাও ঘামাতে হবে না। সরলার বাড়ি চিনিস তো!
ঘাড় নেড়ে সোৎসাহে জগা বলল, খুব চিনি, খুব চিনি।
ব্যস, তাহলে তো অর্ধেক কাজ হয়েই গেল।
পুরো কাজটা কী ঠাকুমা।
ওরে সে খুব সোজা কাজ। তার বালিশের পাশে একটা কাঠের বাক্স থাকে। ঘুম না ভাঙিয়ে বাক্সটা আমাকে এনে দিবি বাপ?
জগা বেশ জোরেই হোঃ হোঃ করে হাসল। তারপর বলল, কার ঘুম ভাঙাবো ঠাকুমা? তিনি তো কবেই পটল তুলেছেন।
ওমা! বলিস কি? সরলা মরেছে কবে?
তা হল অনেক দিন।
ওমা! হুঁড়ি তো এই সেদিনও এক্কাদোক্কা খেলত জামতলায়। একরত্তি বয়স।
জগা মাথা নেড়ে বলে, একরত্তিই বটে, তা একশ পুরে তার ওপর আর চার-পাঁচ বছর ধরুন।
শীতলালক্ষ্মীর গালে হাত। চোখ বড় বড় করে বললেন, বলিস কি রে মুখপোড়া! সে যে আমার চেয়েও দশ-বারো বছরের ছোটো!
তা হতে পারে। হতে বাধা কিসের?
হতে পারে মানে? সরলার যদি একশ চার হয় তাহলে আমার কত হচ্ছে?
জগা বলে, তা হবে একশ পনেরো-ষোলো। কিছু বেশিও হতে পারে।
ওরে বাপ রে! এত বয়স হয়ে গেল নাকি রে আমার! তা কেউ তো বয়সের কথাটা আমাকে বলেনি এতদিন। সরলা যে মরেছে সেও তো টের পেলুম না। হ্যাঁ রে বানিয়ে বলছিস না তো!
জগা এক গাল হেসে বলে, না ঠাকুমা, বানিয়ে বলব কেন? দু-চার বছর এদিক ওদিক হতে পারে, তবে মোটামুটি হিসেবটায় খুব গণ্ডগোল পাবেন না। সরলা ঠাকুমা বেঁচে থাকতে তো ও বাড়িতে কম ঘুরঘুর করিনি। রাতবিরেতে গেলে সরলা ঠাকুমা ঘরের ভেতর থেকে কথাবার্তাও বলতেন। তখনই বলেছিলেন, তাঁর তখন একশ চার চলছে। তাও ধরুন চার পাঁচ বছর তো হয়েই গেল। বেঁচে থাকলে সরলা ঠাকুমার বয়স একশ দশটশই হত।