মুখে-চোখে একটু জল ছিটিয়ে দিলেন রামহরি, তারপর হাত-পা ভাঁজ করে কিছু প্রক্রিয়া চেষ্টা করলেন, মিনিট দশেকের চেষ্টায় সুজন চোখ মেলে চাইলেন, খুব ভ্যাবলা চোখ। যেন কিছুই চিনতে পারছেন না।
আরও মিনিটদশেক বাদে সুজন উঠে চেয়ারে বসতে পরলেন, মুখে কথাও ফুটল।
“ওঃ, মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছে যন্ত্রণায়!”
“কে মারল আপনাকে?” সুজন মাথা নেড়ে বললেন, “জানি না, মুখ ঢাকা দুটো লোক।”
“কখন হল?”
“সন্ধের পর। ঘরে বসে কাজ করছিলাম, কে যেন দরজায় কড়া নাড়ল, উঠে দরজা খুলতেই দুই মূর্তি ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল!”
“তারপর?”
“পিস্তল বার করার চেষ্টা করেছিলাম, পারলাম না, তার আগেই পেছন থেকে মাথায় এমন মারল, তারপর আর কিছু মনে নেই।”
“আপনার ঘরে ঢুকে ওরা তো লুটপাট করে নিয়ে গেছে বলেই মনে হবেই, নাঃ, এ-গাঁ ক্রমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে দেখছি।”
সুজন মাথাটা দুহাতে চেপে বসে ছিলেন, হঠাৎ মুখ তুলে আলমারিটার দিকে চেয়ে বললেন, “সর্বনাশ!”
বলেই তাড়াতাড়ি উঠে এসে আলমারিটার ভেতরে কী যেন আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখলেন, তারপর বললেন, “নাঃ, নিয়েই গেছে!”
“কী নিয়ে গেছে সুজনবাবু?”
“ওঃ সে একটা সোনার গয়না।”
“কীরকম গয়না?”
“ঠিক গয়ন্না নয়। একটা সোনার ঘড়ি। দামি জিনিস।”
কথাটা যেন একটু কেমন ভাবে বলা। রামহরি একটু সন্দিহান হলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
সুজন বললেন, “আমার ঘরে দামি জিনিস বা টাকা-পয়সা তেমন কিছু থাকে না। সবই যেত।”
রামহরি চিন্তিতভাবে বললেন, “সোনার ঘড়িটাই বা কম কিসের? কত ভরি সোনা ছিল ওতে?”
“দু-তিন ভরি হবে বোধ হয় ওজন করিনি।”
“কী ঘড়ি?”
“রোলেক্স।”
“টেবিলের ওপর এই যে ঘড়িটা দেখছি এটাও তো রোলেক্স বলেই মনে হচ্ছে। এটা নয় তো!”
সুজন যেন একটু তটস্থ হয়ে বললেন, “না ওটা তো আমি হাতে পরি। এটা ছিল তোলা ঘড়ি।”
“ওষুধপত্র ঘরে কিছু আছে? ক্ষতস্থানে একটু বরফ দিলে হত।”
“বরফ কোথায় পাব? তবে আমার কাছে কিছু ওষুধ থাকে। চিন্তা করবেন না, সামলে নেব, আপনি এসে না পড়লে কী যে হত।”
রামহরি বললেন, “আমি না এলেও তেমন কিছু হত না। একটু বেশিক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকতে হত আর কি।”
সুজন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমার একটা কথা রাখবেন রামহরি বাবু?”
“বলুন।”
“এ ঘটনাটার কথা কাউকে জানাবেন না।”
“কেন বলুন তো? এত বড় ঘটনা চেপে যাবো?”
চাপতে হবে না। দুদিন সময় চাইছি। আমি নিজে একটু তদন্ত করতে চাই। তারপর বলবেন।
.
১৫.
ঝড়-জলের রাত বলে তো আর ঘরে শুয়ে নাক ডাকলে জগার চলবে না। জগা তাই নিশুত রাতে শহিদলালের দক্ষিণের ঘরের একখানা কমজোরি জানালার পুরো কাঠামটাই খুলে ফেলল, ঝড়-জলের রাত বলে দুটো সুবিধে, আজ রাত-পাহারার লোকেরা কেউ বোরোয়নি, আর দুনম্বর সুবিধে হল, একটু-আধটু শব্দ হলেও কেউ শুনতে পাবে না।
বৃষ্টিটা বেশ চেপেই পড়ছে হাওয়াটাও বেশ তেজালোই, শহিদলালের জামাই এসেছে শহর থেকে। বেশ ফাঁপালো জামাই, তামাক বেচে কাঁচা পয়সা। পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম এঁটে কাল বিকেলেও টহল দিচ্ছিল, চার আঙুলে আংটি, বুকপকেটে সর্বদা দু-পাঁচটা একশো টাকার নোট।
জগা বাঁশবনের দিকটা একটু চেয়ে দেখল। কাজ সেরে এই পথেই সটকে পড়া যাবে।
অন্ধকার ঘরে ঢোকা নানা কারণেই একটু ভয়ের। তাই জগা উঁকি মেরে দেখে নিল ভেতরটা, চোখ তার খুবই ভাল, অন্ধকারেও দেখতে পেল, মশারির ভেতরে লেপমুড়ি দিয়ে মেয়ে-জামাই ঘুমোচ্ছে। জামাইয়ের স্যুটকেসখানা একটা টেবিলের ওপর রাখা, পাঞ্জাবিটা আলনায় ঝুলছে। জিনিসগুলো যেন তাকে দেখতে পেয়ে আহ্লাদে ডাকাডাকি শুরু করে দিল, এসো এসো জগাভায়া, তোমার জন্যে হ্যাঁ-পিত্যেস করে বসে আছি।
জগা জানালায় উঠে ভেতরে লাফ দিয়ে নামল, কাজটা বেশ জলের মতো সোজা বলেই মনে হচ্ছে। মেয়ে-জামাই অঘোর ঘুমে, চারদিক শুনসান, তবে জগা বেশি লোভ করবে না, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। জামাইয়ের স্যুটকেসখানা, সোনার বোতাম সমেত পাঞ্জাবি আর কাঁসার বাসান-টাসন যদি কিছু থাকে।
কাজটা বড্ড সোজা দেখে জগার একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাবও এল। তাই সে তাড়াহুড়ো না করে একটু জিরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল টেবিলের দিকে।
ঠিক এই সময়ে কে যেন খুব চাপা স্বরে বলল, উঁহু!
জগা চমকাল এবং থমকাল, কে কথা কয়? জামাই নাকি?
দাঁড়ানো লোককে সহজেই দেখা যায়, জগা তাই টক করে উবু হয়ে বসে পড়ল। আর বসতেই লোকটার একেবারে মুখোমুখি। টেবিলের নিচে ঘাপটি পেরে জাম্বুবানের মতো বসে আছে, আর জুলজুল করে তাকে দেখছে।
জগা ভয় খেয়ে বলল, জামাই বাবাজি নাকি? ইয়ে-তা-একটু দেখা করতে এলুম আর কি? শত হলেও আপনি গাঁয়ের কুটুম, দেখা না করাটা ভারি অভদ্রতা হয়ে যাচ্ছিল।
লোকটা চাপা গলায় বলল, কৌন জামাই? আমি তো রামপ্রসাদ আছে।
জগা টক করে বুঝতে পারল, লোকটা জামাই নয়। তবে কি পুলিশ টুলিশ? একটু মাথা চুলকে সে বলল, তা সেপাইজি, কেমন আছেন? শরীর গতিক সব ভাল? বাড়িতে বালবাচ্চা সব ভাল তো!
কৌন সিপাহী হ্যাঁয় রে বুরবক? ঐ ঘরে হামি আগে ঘুসিয়েছি, মাল উল সব আমি লিব। তু আভি ভাগ।
জগা এবার জলের মতো পরিষ্কার বুঝতে পারল এ লোকটা জামাইও নয়, সেপাইও নয়। এ লোকটা আর এক চোর, আগেভাগে ঢুকে বসে আছে। বুঝতে পেরেই জগার রাগ হল, বলল, তার মানে? তুমি যেমন রামপ্রসাদ, আমিও তেমনি জগা। তুম ভি মিলিটারি হাম ভি মিলিটারি। ভাগেকা কাহে? মাল উল সরাতে আমিও জানি।