“চার-পাঁচ বরস হবে, গুস্তাকি মাফ করবেন বাবুজি, বাক্সটা কুথায়?”
“কোথায় তা জানলে কি আর বসে আছিরে ব্যাটা? তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও পাইনি। যে সরিয়েছে তাকে হাতের কাছে পেলে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা করতাম।”
“হজুর একটা বাত বলব?”
“বল।”
“রাত হোয়ে আসছে। আধিয়ারি মে হামি কুছু ভাল দেখতে পাই না। আমাকে আভি ছোড়িয়ে দিন। বরখা ভি হোচ্ছে। ভুখ ভি লাগা হ্যাঁয়।”
“বটে! পালাতে চাস? দাঁড়া, আমার একটা স্যাঙাৎ এখনই এসে পড়বে। সে এলে তোর বিচার হবে। তারপর ভেবে দেখব তোকে ছাড়া যায় কি না।”
.
১৪.
রামহরি একটু ভ্রূ কুঁচকে ভাবলেন, সরলা পিসির বন্ধ ঘরে যে নাটকটা হচ্ছে তার কুশীলবকে একটু স্বচক্ষে না দেখলে তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। কিন্তু হট করে ঢুকবার পথ নেই। আর ঢুকলেও যে বিপদ হবে না তা কে বলতে পারে?
ঠিক এই সময়ে রামহরির হঠাৎ মনে হল, তাঁর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, একবার ঘাড় ঘোরালেন রামহরি, কিন্তু ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে কিছু ঠাহর হল না। বৃষ্টির তোড় আর বাতাসের জোর দুই-ই বাড়ছে। রামহরি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, দু-একবার বিদ্যুৎ চমকাল বটে, কিন্তু সে আলোতে কাউকে দেখা গেল না।
রামহরি ভাবলেন, মনের ভুলই হবে। এই দুর্যোগে কে এসে তাঁর পেছনে লাগবে? তবে এখানে আর কালক্ষেপ করা যে যুক্তিযুক্ত হবে না সেটা বুঝতে পারলেন রামহরি। সুতরাং ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেই তিনি দাওয়া থেকে নেমে পড়লেন, তারপর বয়স অনুপাতে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে যত জোরে ছোটা যায় তো জোরেই ছুটতে লাগলেন। কিন্তু সম্মুখে এত ঘুটঘুটি অন্ধকার যে, দৌড় কেন হাঁটাও খুব কঠিন, রামহরি প্রথমে একটা বাগানের বেড়া ভেঙে হুড়মুড় করে পড়লেন, তাতে “চোর, চোর” বলে কেউ চেঁচিয়ে ওঠায় ভয় খেয়ে রামহরি আর এক দফা ছুটতে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেজায় ধাক্কা খেয়ে ধরণীতলে জলকাদায় পপাত হলেন, এবং ফের উঠে দিগভ্রান্ত হয়ে কোথায় যে যাচ্ছেন তা বুঝতে না পেরে হাঁটতে লাগলেন।
একবার তাঁর মনে হল পথ ভুলে গাঁয়ে ঢোকার বদলে গাঁয়ের বাইরেই চলে এলেন নাকি? এখন চেপে বৃষ্টি হচ্ছে, বিদ্যুতের চমকানি নেই বলে রাস্তাঘাট কিন্তু ঠাহর করার উপায় দেখছেন না। এ অবস্থায় হাঁটা অতীব বিপজ্জনক। কোন খানাখন্দ পুকুরে-ডোবায় পড়েন তার ঠিক কী?
রামহরি সুতরাংএকটা গাছ ঠাহর করে তার নিচে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছোটোছুটিতে যথেষ্ট ধকলও গেছে। একটু জিরোনোও দরকার। সরলাপিসির বাড়িতে কারা ঢুকে বসে আছে সে কথাটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সার কথাও ভুলতে পারছেন না।
ঝড়বৃষ্টি এবং ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের ভেতরে হঠাৎ রামহরি একটা ক্ষীণ আলোর রেশ দেখতে পেলেন। সামনে, পঞ্চাশ-ষাট গজ দুরে যেন একটা লণ্ঠনের আলো দেখা যাচ্ছে। মনে হল, কোনও বাড়ি থেকেই আলোটা আসছে, যার বাড়ি হোক আশ্রয় তো আপাতত জুটবে, গাঁয়ের সব লোকই তো চেনা।
রামহরি গুটিগুটি আলোটার দিকে এগোতে লাগলেন, যত এগোচ্ছেন আলোটা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, গাছপালার মধ্যে বাড়ির মতো কিছু একটার আকার দেখা যাচ্ছে। রামহরি জয়দুর্গা’ বলে এগিয়ে একেবারে বাড়ির দাওয়ায় উঠে পড়লেন, পাকা দালান, সামনেই একটা ঘরের কাঁচের শার্শি দিয়ে লণ্ঠনের জোরালো বাতি দেখা যাচ্ছে। চিনতে আর ভুল হল না রামহরির, কাঁচের শার্শিওলা বাড়ি হরিপুরে একটাই আছে। এ হল সুজন বোসের বাড়ি।
সুজন বোসের বাড়িতে সর্বদা গরম কফি পাওয়া যায়। মানুষটি পণ্ডিতও বটে, কথা কয়ে যেন আরাম, গা পুঁছে একটু জিরিয়ে বৃষ্টির তোড়টা কমলে বাড়ি যাওয়া যাবে।
দরজার কড়া নেড়ে রামহরি হাঁক মারলেন, “সুজনবাবু আছেন নাকি? ও সুজনবাবু–”
কেউ সাড়া দিল না। রামহরি আরও বারকয়েক হাঁকডাক করলেন, আশ্চর্যের ব্যাপার! ভেতরে আলো জ্বলছে। তালাও দরজায় দেওয়া নেই, তবে লোকটা কি বাথরুম-টাথরুমে গোছে? রামহরি জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন, জানালায় একটা হাফ পরদা টানা থাকায় কিছুই দেখতে পেলেন না প্রথমে। কিন্তু পরদার ডানদিকে নিচের কোনাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। দেখে সেখানে চোখ পেতে রামহরি আপনমনেই বলে উঠলেন, সর্বনাশ!
যা দেখলেন তা হল পায়জামা-পরা দুখানা পা মোঝতে সটান হয়ে আছে। এক পায়ে চটি, অন্য পা খালি, এর মানে সুজন হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে গেছে, যেমনটা স্ট্রোক হলে হয় নইলে অন্য কিছু…
রামহরি আতঙ্কিত হলেও তিনি কবিরাজ মানুষ, লোকের রোগ ভোগ, বিপদ দেখলে পালানো তাঁর ধর্ম নয়, তিনি দরজায় ফের ধাক্কা দিলেন, তারপর ওপর দিকটা হাতড়ে দেখলেন, বাইরে থেকে শেকল তোলা আছে। শেকলটা খুলতেই বাতাসের ধাক্কায় দরজার দুটো পাল্লা ধড়াস করে খুলে গেল।
ঘুরে ঢুকেই আগে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি দিলেন রামহরি। তারপর দেখলেন ঘরটার অবস্থা লণ্ডভণ্ড। স্টিলের আলমারিটা হাঁ করে খোলা। সুজন মেঝেতে সটান হয়ে শুয়ে আছেন উপুড় হয়ে।
হাঁটু গেড়ে বসে আগে নাড়ীটা পরীক্ষা করলেন রামহরি, নাড়ী আছে, প্রাণে বেঁচে আছে লোকটা। ভাল করে পরীক্ষা করতে গিয়ে রামহরি সুজনের মাথার পেছনে ক্ষতস্থানটা আবিষ্কার করলেন। লাঠি বা ওরকম কিছু নয়, নরম ভারী জিনিস দিয়ে সুজনকে মারা হয়েছে মাথায়। তার ফলে জায়গাটা ফুলে কালশিটের মতো পড়লেও রক্তক্ষরণ তেমন হয়নি, রবারের হোস দিয়ে মারলে এরকম হতে পারে।