“তা তো জানি না পিসি। চোর-ছ্যাঁচড়দের সঙ্গে আপনারই দরকারটা কী?”
“ওই যে বললুম তোকে, তারা এলে দুটো কথা কয়ে বাঁচতুম। দু চারজনের সঙ্গে তো বেশ ভাবই হয়ে গিয়েছিল। কালীচোর ছিল, সাতগাঁয়ে বাড়ি। চার ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে বড় সংসার। তার আবার হাতে বাতব্যাধি ছিল। বউটা দজ্জাল বলে কত দুঃখ করত। আর ছিল নবা চোর। একেবারে ছেলেমানুষ। তার সৎ-মা বলে বাড়িতে আদর ছিল না। একবার তাকে জানালা গলিয়ে এক বাটি পান্তা ভাত খাইয়েছিলুম। আরও ছিল গণশা চোর। খুব পাজি ছিল। জানালায় দমাদম ইট মারত। একখানা টাকা ছিল তার বরাদ্দ। টাকা দিলেই চলে যেত।”
রামহরি হাসলেন, “উরেব্বাস! এ তো সাঙ্ঘাতিক কথা।”
“তা বাবা, চোরসকল যে উধাও হয়ে গেল। এরকমটা কি ভাল?”
“লোকে তো বলে চোর-ছ্যাঁচড় না থাকাই ভাল।”
“সে তোদের বেলায়। আমার বাপু, চোরটোর তেমন খারাপ লাগে না।
রামহরি মাথা চুলকে বললেন, “একা থেকে থেকে আপনার মাথাটাই গেছে দেখছি পিসি। তা একা থাকবার দরকারটাই বা কী? একজন কাজের মেয়ে রেখে দিন না, সে দিনরাত থাকবে আর মনের আনন্দে তার সঙ্গে বকবক করবেন।”
ওরে বাবা, কাজের মেয়ে রাখব কী রে? তারা যে ভীষণ চোর হয়। আমি বুড়োমানুষ, কোথা থেকে কোন জিনিসটা সরাবে টেরও পাব না।”
রামহরি হেসে ফেললেন, “তা সরালে সরাক না। আপনি তো চোরই খুঁজছেন?”
“না, না বাবা, ঘরে চোর পুষতে পারব না। তবে আমার এখন একজন চোর খুব দরকার। একটা ভাল দেখে চোর খুঁজে পেতে দিবি বাবা? আনাড়ি হলে চলবে না। বেশ পাকা চোর চাই। পারবি?”
রামহরির তো একগাল মাছি। সরলা পিসির মাথাটা যে একটু বিগড়েছে যে বিষয়ে তাঁর আর সন্দেহ রইল না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মাথা বিগড়োনোর অন্যান্য লক্ষণ ঠিকমতো মিলছে না। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “আচ্ছা দেখব’খন। আমার কাছে রুগি যারা আসে তাদের মধ্যে খুঁজলে হয়তো একআধজন চোর পাওয়া যেতেও পারে।”
“ওরে না না, ব্যাপারটা হালকাভাবে নিসনি। শক্ত কাজ, পাকা হাতের চোর ছাড়া পেরে উঠবে না।”
রামহরি অবাকের ওপর আরও অবাক হয়ে বললেন, “চোরকে দিয়ে কী কাজ করবেন পিসি?”
“তোর মাথায় কি গোবর রে রামহরি? চোর চাইছি কি চণ্ডীপাঠ করবে বলে?”
“তাহলে?”
“চোরকে দিয়ে চুরিই করাব বাবা। তবে কাজটা শক্ত। তাই পাকা হাতের লোক খুঁজছি।”
“চুরি করাবেন পিসি? কী সব্বোনেশে কথা! কী চুরি করাবেন? কেন চুরি করাবেন? চুরি করা যে মহা পাপ।”
ফোকলা মুখে এক গাল হেসে সরলা পিসি বলল, “শান্তরের কথা কি আর জানি না রে বাপ! সব জানি, চুরি করা পাপ, মিথ্যে কথা বলা পাপ, আরও কত পাপ আছে।”
“তাহলে চুরি করতে চাইছেন কেন?”
“কথাটা ভেঙে বলতে পারছি না রে বাপ। বলতে ইচ্ছে যাচ্ছে বটে, কিন্তু কথাটা এখুনি ফাঁস হয়ে গেলে মুশকিল। আগে একটা ভাল দেখে চোর এনে দে, কাজটা উদ্ধার হোক, তারপর একদিন তোকে সব খুলে বলব।”
রামহরির যদিও সরলা পিসির মাথার গণ্ডগোল হয়েছে বলে সন্দেহ রয়ে গেল, তবু চোরও তিনি কিন্তু খুঁজেছিলেন। তাঁর রুগিদের মধ্যে একজন ছিল নিতাই পাল। তার আধকপালে মাথা ধরার জন্য চিকিৎসা করাতে আসত। নিতাই নানা জায়গায় ঘোরে, খুব ফিকিরফন্দি জানে। তা তাকেই রামহরি চোরের কথা বললেন, “ও নিতাই, আমাকে ভাল একজন চোরের সন্ধান দিতে পারো?”
“চোর!” বলে নিতাইয়ের যে কী হাসি, হাসি আর থামেই না, তারপর বলল, “কবরেজমশাই, ব্যাপারটা কী?”
“সে আছে, বলা যাবে না।”
“বলি চোর ধরে তাকে বেটে বা ঘেঁতো করে ওষুধ বানাবেন না তো! আয়ুর্বেদে নাকি কিম্ভুত আর বিটকেল নানা জিনিস দিয়ে ওষুধ বানায়।”
“আর না না অন্য ব্যাপার।”
তা নিতাই এনেছিল দুটো চোরকে, একজন ফিচকে, অন্যজন ফটিক, দুজনেরই বয়স কম, দুজনেই রোগা, দু’জনেই কালো, দুজনেরই মাথায় বাবরি চুল, দুজনের চোখেই বেশ চালাক-চালাক দৃষ্টি আর দু’জনেরই মুখে মিচকে হাসি, রামহরি বুঝলেন, এরা সত্যিই কাজের লোক।
দুজনকেই সরলা পিসির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন রামহরি, চোর দেখে পিসির আনন্দ আর ধরে না। তাড়াতাড়ি মুড়ির মোয়া আর নাড়ু খেতে দিলেন। তারপর রামহরিকে বললেন, “তোর উপকারের কথা ভুলব না। এবার তুই বাড়ি যা এদের সঙ্গে আমার গোপন শলাপরামর্শ আছে।”
এতদিন বাদে সেইসব কথা মনে পড়ে রামহরির একটু হাসি পাচ্ছিল, চোর দিয়ে সরলা পিসি কী করেছিল তা আজও জানে না রামহরি।
সামনেই একটা তালগাছের মাথায় নীল একটা বিদ্যুতের ধাঁধানো শিখা নেমে এল। দপ করে আগুন জ্বলে উঠল গাছের মাথায়। তারপর যে বাজের শব্দটা হল তা থেকে কান বাঁচাতে রামহরি দু’কান চেপে ধরে রইলেন।
তারপরই হঠাৎ শুনতে পেলেন খুব কাছে কারা যেন কথা কইছে, একটু থতমত খেয়ে ঠাহর করে শুনলেন, তালাবন্ধ ঘরের ভেতর থেকে কথা শোনা যাচ্ছে। রামহরির মেরুদণ্ড বেয়ে হিমের স্রোত নেমে গেল।
.
১৩.
রামহরি আসলে সাহসী মানুষ, বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে কথার আওয়াজ পেয়ে প্রথমটায় ভয় খেলেও সামলে গেলেন। তারপর জানালার বন্ধ পাল্লায় গিয়ে কান পাতলেন, ঝড়-বৃষ্টির শব্দে প্রথমটায় কিছু শুনতে পেলেন না। কিন্তু প্রাণপণ মনঃসংযোগ করে থাকার ফলে একটু বাদে শুনতে পেলেন, কে যেন কাকে বলছে, “হাঁ হাঁ বাবু ও বাত তো ঠিক আছে, কসুর হই গিছে বাবু। হামি সমঝলাম কি বহোত দিন বাদে ইস তরফ যখন এসেই গেছি তখন বুড়ি মায়ের সঙ্গে একটু বাতচিত করিয়ে যাই। উসি লিয়ে–”