আপনি কী বললেন?
আমি কিছু বুঝতে পারিনি আর সেটাই বললাম।
আপনি কি জানেন যেদিন সে গুম হয় সেদিন আমাদের নাকের ডগা দিয়ে বাক্সটা লোপাট হয়ে যায়?
তাও জানি।
ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হচ্ছে না?
হচ্ছে।
ওই কড়ি আর পয়সা কোনও সঙ্কেতও হতে পারে তো!
হতেই পারে। কিন্তু সেই সঙ্কেত ভেদ করার মতো বুদ্ধি আমার নেই। আপনাদের বলি, এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে এত ভাবছেন কেন? গাঁয়ের মানুষ সহজেই রহস্যের গন্ধ পায়। আমি বিজ্ঞানী বলেই বাস্তবভাবে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি। ওই পয়সা আর কড়ির ভেতরে কোথাও সংকেত বা রহস্য না থাকারই সম্ভাবনা বেশি। যে বাক্সটা চুরি করেছে সে গুপ্তধনের সম্ভাবনার কথা ভেবেই করেছে হয়তো। কিন্তু লাভ হবে বলে মনে হয় না।
গদাই বলল, রাত আটটার সময় শূলপাণি রোজ অট্টহাসি হাসত। এখন সেটাকেও অনেকে সংকেত বলে মনে করছে। আপনার কী মনে হয়?
সুজন মৃদু হেসে বললেন, “হাসিটা আমিও শুনেছি। কিছু মনে হয়নি। বাতিক ছাড়া কিছু নয়।
নগেন দারোগা হতাশার গলায় বলল, না, আপনি দেখছি সবই উড়িয়ে দিচ্ছেন।
সব উড়িয়ে দিচ্ছি না। আপনারা যা বললেন এসব নিয়েও ভাবব।
গদাই নস্কর আর নগেন দারোগা উঠতে যাচ্ছিল, সুজন বললেন, “একটা কথা, গোপেশ্বর গোস্বামীকে তো চেনেন নিশ্চয়ই।
নগেন বলল, চিনবো না? সে নে গাঁয়েরই লোক?
লোকটা কেমন?
মিটমিটে বিচ্ছু টাইপের, তবে তার নামে তেমন বড় কোনও অভিযোগ নেই। কেন বলুন তো?
এমনিই, কৌতূহল, সে মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে।
কী বলে সে?
সুজন একটু হেসে বললেন, “কূটকচালি করতেই আসে। লোকটাকে সুবিধের ঠেকে না।
নগেন মাথা নেড়ে বলে, লোক সুবিধের নয় ও। তেমন কিছু হলে জানাবেন, ধমকে দেবো।
না, না, ধমকানোর কিছু নেই।
দুজনে চলে যাওয়ার পর সুজন উঠলেন। স্নান-খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর একখানা মোড়ে আছে। মোপেডটা ঘর থেকে বের করে উঠোনে নামিয়ে স্টার্ট দিলেন। তারপর গাঁয়ের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে গাড়িটা চালিয়ে দিলেন।
হরিপুর ছাড়িয়ে মাইল পাঁচেক আসার পর মোপেড় থামিয়ে কাঁধের থলি থেকে একটা শক্তিশালী ক্ষুদে দূরবীন বের করে পেছনের দিকটা ভাল করে লক্ষ্য করলেন সুজন, না, কেউ আসছে না অনুসরণ করে। নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি ফের গাড়ি ছাড়লেন।
প্রায় কুড়ি মাইল তফাতে সাতগাঁ। গ্রামের উত্তর দিকে একখানা পাকা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নামলেন সুজন। বারান্দায় উঠে দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে একটা বেঁটে লোক উঁকি দিল।
আরে, আপনি?
জরুরী কথা আছে।
আসুন, ভেতরে আসুন।
সুজন ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
.
১২.
সন্ধের মুখে আজও ঝোড়ো হাওয়া ছাড়ল এবং ঘন মেঘ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর নামল তেড়ে বৃষ্টি।
কবিরাজ রামহরি কিছু গাছ-গাছড়ার খোঁজে হরিপুরের দক্ষিণে গড়নাসিমপুরের জঙ্গলে গিয়েছিলেন। ফেরার সময়ে এই দুযোগ। সঙ্গে অবশ্য ছাতা ছিল, কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতা উল্টে শিকগুলো ছয় ছত্রখান। ঠাণ্ডা হাওয়ায় বরফের কুচির মতো বৃষ্টির ফোঁটা থেকে মাথা বাঁচাতে রামহরি দৌড়ে সামনে যে বাড়িটা পেলেন তার মধ্যেই ঢুকে পড়লেন।
ঢুকেই খেয়াল হল এটা সরলাবুড়ির বাড়ি। এ-বাড়ি থেকে শূলপাণি নিরুদ্দেশ মনায় আঠ দাঁড়ালেন জটি দেখলেন। চারদিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ভয়ে লোকে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আসে না।
রামহরি দাওয়ায় উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু দাওয়াতেও বৃষ্টির প্রবল ছাঁট আসছে। হাতড়ে হাতড়ে ঘরের দরজাটা দেখলেন। বেশ বড়সড় তালা লাগানো। সুতরাং ঘরে ঢুকে যে গা বাঁচাবেন সে উপায় নেই। চারদিকে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। ব্যাঙ ডাকছে পেছনের পুকুরে। গাছপালায় বাতাসের
অতিপ্রাকৃত শব্দ হচ্ছে। যেন পেত্নীর শ্বাস। / রামহরি গাঁয়ের লোক, সহজে ভয় খান না। কিন্তু আজ যেন গা-টা একটু ছমছম করছে। সরলাবুড়ির বাড়িটা গাঁয়ের বাইরে। কাছেপিঠে অন্য বাড়িঘর নেই। সরলা পিসির সাহস ছিল বটে। একা এই নির্জন পুরীতে বুড়ি দীর্ঘদিন বাস করেছে। শূলপাণি তো এল এই সেদিন।
কবিরাজি চিকিৎসায় খুব বিশ্বাস ছিল পিসির। শেষ কয়েক বছর রামহরিই তার চিকিৎসা করেছেন। বাড়িটার দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আজ অনেক কথা মনে পড়ছিল রামহরির। বিশেষ করে এক সন্ধেবেলার কথা। খুব শীত পড়েছিল সেদিন। গড়নাসিমপুরের জঙ্গলে সেইদিনই সন্ধেবেলা বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছিল। খুব কুয়াশা ছিল চারদিকে। এটা যে সময়ের কথা তখন শূলপাণি আসেনি।
রামহরি যখন বুড়ির নাড়ী দেখছিল মন দিয়ে তখন বুড়ি হঠাৎ বলল, “ও বাবা রামহরি, তোকে একটা কথা বলব?”
“বলুন পিসিমা।”
আগে এ-গাঁয়ে মেলা চোর-ছ্যাঁচড় ছিল। বাইরে থেকেও আসত সব দেহাতি চোর। এ-বাড়িতে মাঝরাতেই আনাগোনা করত তারা। তখন ঘরের দোর এঁটে বসে খুব বকাঝকা করতুম তাদের। তা তারাও মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বাইরে থেকে ঝগড়া করত। দু-চারটে চোরের সঙ্গে এ-ভাবেই বেশ ভাব সাব হয়ে গিয়েছিল।
রামহরি অবাক হয়ে বললেন, “তাই নাকি? এ তো সাঙ্ঘাতিক কথা পিসি!”
একগাল হেসে বুড়ি বলল, “তা কী করি বল। আমার তিনকুলে কেউ নেই, গাঁয়ের লোকও কেউ বড় একটা আসে না। একা থাকি। তা চোর ছ্যাঁচড়দের সঙ্গেই যা একটু কথাটথা বলতুম। এখন তারা আর আসে না। কেন বলতে পারিস?”