জানি বাপু, তুমি বড় কাজের লোক। তা বলি কখনও শূলপাণির কাছে কাউকে যাতায়াত করতে দেখনি?
তা দেখব না কেন? শূলপাণি বাবাজীর কাছে সবাই যেত। এমন কি গোঁসাই, আপনিও যেতেন। কতদিন দেখেছি আপনি আর জটেশ্বরদাদা মুড়িসুড়ি দিয়ে গভীর রাতের দিকে বাবাজীর ডেরায় গিয়ে সেঁধোচ্ছেন।
আহা, আমরা গাঁয়ের লোক, তার ভালমন্দের খোঁজ নিতে যেতুম আর কি! আমাদের কথা হচ্ছে না। বাইরের কেউ আসত? অচেনা মানুষজন?
তাও আসত। তবে কার কথা জানতে চান সেইটে খোলসা করে বলুন।
ইয়ে ধরো যদি বলি একজন খুব বেঁটেখাটো লোক?
জগা আর পাগলু ফের মুখ তাকাতাকি করে নেয়।
জগা বলল, তা নানা সাইজেরই আসত। বেঁটে, লম্বা, মোটা, রোগা, কালো, ধলা।
আমি একজন বিশেষ বেঁটে লোকের কথা বলছি।
পাগলু বলল, বড্ড খিদে পেয়ে গেল যে গোঁসাই। এই অবস্থায় তো কথা চলে না।
গোপেশ্বর গম্ভীর হয়ে বলে, তাই বুঝি? বলি কথাটা ভাঙবার জন্য ঘুষ চাও নাকি? ঠিক আছে, দিনুর কাছ থেকে যে টাকা খেয়েছে সেটা নগেন দারোগার কানে তুলে দেবোখন। নগেন দারোগা রিটায়ার করলে কী হয় এখনও পাপীতাপীর যম।
পাগলু খিক করে একটু হেসে বলল, সে আপনার ইচ্ছে হলে বলুন গে। আর ইদিকে আমরাও কথাটা একটু দিনুর কাছে নিবেদন করে দেবোখন যে, আপনি আমাদের ভয়টয় দেখাচ্ছেন।
গোপেশ্বর গম্ভীর হয়ে বলল, প্যাঁচ কষছো ভায়ারা?
তা আপনি কষলে আমাদেরও কষতে হয়।
গোপেশ্বর ফের মোলায়েম হয়ে বলে, দারোগাবাবুকে বলে দেবো বলেছিলাম, তা সে কথাটা ধোরো না। আসলে কী জানেনা, খবর পেয়েছি। একটা বেঁটেমতো লোক শূলপাণির কাছে খুব যাতায়াত করত। শূলপাণির গুম হওয়ার পেছনে তার হাত থাকতে পারে।
জগা বলল, গুমটুম বাজে কথা। শূলপাণি বাবাজীর আর এখানে পোষাচ্ছিল না, তিনি হিমালয়ে গিয়ে সাধু হয়েছেন বলেই লোকের বিশ্বাস।
গোপেশ্বর খানিকক্ষণ চিন্তিতভাবে বসে থেকে হঠাৎ বলল, জিলিপি খাবে নাকি ভায়ারা? তা এই নাও পাঁচটি টাকা। আমি গরিব মানুষ, এর বেশি পেরে উঠব না। এতে কি হবে?
জগা ঘাড় হেলিয়ে বলল, হয়ে যাবে কোনওরকমে, কী বলল পাগলুদাদা?
পাগলু বিরক্ত হয়ে বলল, তোর বড় ছোটো নজর রে জগা।
আহা বোষ্টম মানুষ, যা দিচ্ছেন নিয়েই নাও।
পাগলু অনিচ্ছুক হাতে টাকাটা নিয়ে ট্র্যাকে খুঁজে বলল, বেঁটে লোকটাকে আপনার কিসের দরকার?
বেঁটে বলে তাকে অবহেলা কোরো না ভায়ারা। তার নামে একটা তল্লাট কাঁপে। ছোটোখাটো মানুষ হলে কি হয়, সে হল অ্যাটম বোম। তার নাম হল নিতাই পাল। চেনো?
একগাল হেসে পাগলু বলল, নিতাই পালকে চিনব না। তবে তিনি যে এত ভয়ঙ্কর লোক তা জানা ছিল না।
অনেক কিছুই তোমাদের জানা নেই ভায়া। তা নিতাই আসত?
প্রায়ই আসতেন। কী সব গুজগুজ ফুসফুস কথাও হত দুজনের মধ্যে।
বটে!
আজ্ঞে। সাতগাঁ না কোথায় যেন বাড়ি।
সাতগাঁয়েই।
আপনি কি তাকে চেনেন গোঁসাই?
চিনি মানে ওই আর কি। মুখ চেনা বলতে পারো। কথাটা হল, নিতাই পালকে একটু ফিট না করলেই নয়। তাকে চেপে ধরলে শূলপাণির খবর পাওয়া যাবে। আর শূলপাণির খবর পেলে সরলাবুড়ির গুপ্তধনেরও হদিস মিলবে।
জগা হেসে উঠে বলল, গোঁসাই গুপ্তধনের স্বপ্ন দেখছেন। ওসব বাজে কথা। সরলাবুড়ির বাড়ি আমরা আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখেছি। গুপ্তধন নেই।
আলবাৎ আছে। অন্তত দু ঘড়া মোহর।
১১-১৫. সুজন বোস একটু চিন্তিত
সুজন বোস সকালবেলা থেকেই একটু চিন্তিত, তিন কাপ কালো কফি খেয়ে বাগানে পায়চারি করে চিন্তার জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন, তাতে মাথার মেঘ কাটেনি। এখন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ নিজের ল্যাবরেটারিতে বসে একটা সায়েন্স ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছেন।
দক্ষিণের জানালার দিকটায় ফণিমনসার ঝোঁপজঙ্গল, সেদিক থেকেই মৃদু একটু গলা খাঁকারির আওয়াজ এল।
সুজন ভ্রুটা সামান্য কুঁচকে মৃদু গলায় বললেন, ।আসতে পারো।
মিনিটখানেক বাদে ল্যাবরেটারির খোলা দরজায় পাগলু এসে বশংবদ মুখ করে দাঁড়াল।
কী খবর পাগলু?
আজ্ঞে খবর তো মেলা, ধীরে ধীরে বলতে হবে। সময় লাগবে।
সুজন একটু হেসে বললেন, গাঁয়ের লোকের একটা দোষ কী জানো? তাদের কাছে সময়ের কোনও দামই নেই। সময় কেমন করে কাটাবে তাই তারা ভেবে পায় না। এক মিনিটের কথা এক ঘণ্টা ধরে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলে।
তা যা বলেছেন।
গুরুতর খবর হলে বলতে পারো, তবে সংক্ষেপে।
যে আজ্ঞে। আমার এক স্যাঙাত আছে, জগা। জানেন তো!
শুনেছি, চোর তো!
আজ্ঞে, তবে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। আজ তাকে দিনুগুণ্ডা ধরেছিল একটা খুনের কাজে লাগানোর জন্য। আর গোঁসাই গোপেশ্বর আমাদের পাকড়াও করেছিল নিতাই পালের খবরের জন্য।
ভ্রুটা একটু কোঁচকালো সুজনের। বললেন, নিতাই পালের কথা সে কী বলছে?
সে বলছে নিতাই পালই নাকি শূলপাণিকে গুম করেছে।
সুজন গম্ভীরভাবে শুধু বললেন, গুম। আর কিছু?
মাথা নেড়ে পাগলু বলল, সংক্ষেপে বলতে বলছেন, তাই সংক্ষেপেই বললুম, তবে গোপেশ্বরের বিশ্বাস সরলাবুড়ির দু ঘড়া মোহর আছে।
সুজন একটু হাসলেন, বললেন, বমোহরের গপ্পো আমিও শুনেছি। মোহর কি ছেলের হাতের মোয়া?
আজ্ঞে, আমরাও তাই বলেছি।
ঠিক আছে, এখন যাও। পরঞ্জয়বাবুর খবর-টবর একটু নিও।
আজ্ঞে নিয়েছি। কাল রাতেই গিয়েছিলাম। দিব্যি মনের আনন্দে আছেন। কোনও খবর দিতে হবে কি?