দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠে, কিছু না। কিছু না।
গোপেশ্বর মৃদু হেসে বলল, জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞানতাই কখনও সখনও ভাল বলে মনে হয়। যত না জানা যায় ততই বিপদের ভয় কম, কে আর ঝাটে জড়াতে চায় বলো!
দুজনেই বলল, ঠিক কথা।
তবু জিজ্ঞেস করছি কেন বলো? তোমরা দুটি তো সব বাড়িতেই রাত বিরেতে হানা দাও। অনেক সময়ে আড়ি পেতে ভেতরকার গুহ্য কথাও শুনে ফেল। অনেকের হাঁড়ির খবর তোমাদের একেবারে নখদর্পণে। তাই না?
জগা লজ্জিত হয়ে ঘাড়টাড় চুলকে বলে, না না, কী যে বলেন। সামান্য মানুয আমরা।
গোপেশ্বর মাথা নেড়ে বলে, আহা, অত বিনয় করতে হবে না। তোমরা যে কাজের লোক তা আমি ভালই জানি।
যে আজ্ঞে।
শোনো ভায়ারা, শূলপাণি হঠাৎ যেন গায়েব হয়ে গেল সেই কথাটা আমার জানা দরকার।
পাগলু মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে আমরা কাজটা করিনি। ছোটোখাটো চুরি-ছাচড়ামি করে থাকি বটে, কিন্তু গুম বা খুনটুন আমাদের লাইনের ব্যাপার নয়।
কাজটা যে তোমরা করেছে এমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। বলছি কি, শূলপাণির ঘরে কখনও হানাটানা দিয়েছো?
জগা বলল, আজ্ঞে না। ওখানে গিয়ে হবেটা কী? শূলপাণি পাগল মানুষ, কুকুর-বেড়াল নিয়ে থাকত, তার বাড়িতে হানা দিয়ে হবে কোন লবডঙ্কা?
তা বটে। কিন্তু শূলপাণি যে নিয্যস পাগল একথাটা আমার প্রত্যয় হয় না। আমার বরাবরই মনে হয়েছে শূলপাণি একজন সাজা পাগল।
পাগলু অবাক হয়ে বলে, বটে! তাহলে তো আপনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখেন।
খবর তুমিও বড় কম রাখো না।
পাগলু একটু তেড়িয়া হয়ে বলে, তার মানে?
মানে আমার চেয়েও তোমাদের আরও বেশি খবর রাখার কথা। তোমাদের দুজনেরই শূলপাণির বাড়িতে রীতিমতো যাতায়াত ছিল। আমার স্বচক্ষে দেখা। অস্বীকার করে লাভ নেই।
জগা আর পাগলু ফের একটু মুখ তাকাতাকি করে নেয়। তারপর পাগলু গলাটা একটু নামিয়ে বলে, সে ঠিক কথা, আমরা ভাবতুম সে মস্ত ম্যাজিসিয়ান, কোন বিপদে কখন কোন কাজে লাগে কে জানে। তাই ম্যাজিক শিখতে কিছুদিন যেতুম বটে।
শূলপাণি তোমাদের কী ম্যাজিক শেখাতো?
জগা রেগে উঠে বলল, কিছু না মশাই, কিছু না। আমরা গেলেই সে অংবং করে কী সব বলত, মুখ ভ্যাঙাতো, অঙ্গভঙ্গি করত, দু-চারবার ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়াও করেছে।
বটে, এ তো খুব অন্যায় কথা!
অন্যায় বলে অন্যায়! তাকে খুশি করার জন্য ধারকর্জ করে বনমালীর তেলেভাজা, আসগরের চপ, গোবিন্দপুরের দৈ কতবার ভেট নিয়ে গেছি। তা উনি সেসব বেশ জুৎ করেই খেতেন, কিন্তু শেখানোর বেলায় লবডঙ্কা।
কিন্তু বাপু, কথাটা হল সে যে ম্যাজিক জানে একথাটা তোমাদের বলল কে?
জগা মাথা চুলকে বলল, অনেকেই বলাবলি করত, ওরকম ধারা খ্যাপাটে মানুষেরা কিছু না কিছু গুপ্তবিদ্যে জানেই মশাই, হাটে-বাজারে লোকে বলাবলি করত শূলপাণি নাকি রাত-বিরেতে পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়ায়, তার বাড়িতে নাকি জিন-পরি-ভূতপ্রেত নিত্যি আসা-যাওয়া করে।
তুমি নিজে কি কিছু দেখেছো?
মাথা নেড়ে জগা বলে, না মশাই, আমাদের যে কিছু দেখাত না। আমরা গেলেই পাগল সাজত।
আচ্ছা, একটা কথা।
বলুন।
রাত আটটার সময় শূলপাণি যে অট্টহাসিটা হাসত সেটা কখনও শুনেছো?
শুনব না? রোজ শুনতুম। গাঁশুদ্ধু লোকও শুনত।
যে সময়ে সে হাসত সে সময়ে কখনও তার কাছে ছিলে?
যে আজ্ঞে।
কিরকমভাবে হাসত একটু বলবে?
আজ্ঞে সে বড় বিদঘুঁটে হাসি। শুনে পিলে চমকে যেত। প্রথম দিন ওই হাসি শুনে তো আমার মূৰ্ছা যাওয়ার জোগাড়।
কেন হাসত তা জানো?
আজ্ঞে না।
কখনও জিজ্ঞেস করেছিলে?
তা করেছিলুম। প্রথম দিন যখন সন্ধের মুখে তাঁর কাছে যাই তখন খানিকতক গরম গরম জিবেগজা নিয়ে গিয়েছিলুম। তা উনি জিবেগজা খেতে খেতে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন। চোখ দুটো আধবোজা, একটু একটু দুলছেন বসে বসে। আমি হাতজোড় করে সামনেই বসে আছি। হঠাৎ যেন। ভূমিকম্পের মতো কী একটা হয়ে গেল। বললে বিশ্বাস করবেন না। ঠিক যেন নাভি থেকে শব্দটা ওঁর গলায় উঠে এল। এমন দমকা লহর তোলা হাসি জীবনে শুনিনি বাবা। ভিরমি খেয়েছিলাম মনে আছে। তারপর চেতন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাবাজী, এটা কী হল?
তা উনি কী বললেন?
বলাটলার ধার ধারতেন নাকি? শুধু একবার কটমট করে তাকালেন।
কেন হাসত তা ঠাহর করেছো কখনও?
মাথা নেড়ে জগা বলল, আজ্ঞে না!
তোমরা কি জানো যে শূলপাণি একেবারে ঘড়ি ধরে ঠিক রাত আটটার সময়ে হাসিটা হাসত, কখনও এক চুল এদিক-সেদিক হত না?
পাগলু বলল, আজ্ঞে সেরকমই শুনেছি। কিন্তু আমাদের তো আর ঘড়ি নেই যে মিলিয়ে দেখব।
গলাটা আরও এক পর্দা নামিয়ে গোপেশ্বর বলল, আরও একটা কথা ভায়ারা। শূলপাণির বাড়ি থেকে নাকি লাল নীল সবুজ ধোঁয়া বেরোতো তোমরা দেখেছো নাকি?
দুজনেই মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে না।
আচ্ছা, ধোঁয়া নয় না-ই দেখলে, আর কিছু দেখনি? চোখে লাগে এমন কিছু?
জগা ফস করে বলে ওঠে, অনেকক্ষণ ধরে বকাচ্ছেন মশাই। আমাদের তো সময়ের একটা দাম আছে।
গোপেশ্বর ভারি অমায়িক হেসে বলে, তা আছে ভায়ারা, তা অবশ্যই আছে। একটু আগেই যেন দেখলুম। আমাদের জগা ভায়া দিনুর কাছ থেকে কড়কড়ে দুশো টাকা পেল! তা সেটাও কি ওই সময়েরই দাম নাকি?
জগা একটু দমে গেল। বলল, ঠিক আছে, যা জিজ্ঞেস করার করুন, তবে সময় বেশি নেবেন না। বেলা চড়ছে, আমাদের বিষয়কৰ্ম পড়ে আছে কিনা।