“হাজার? এই না বিশ লাখ বললি?”
“বলেছি! পাগলুদাদা, আমাদের কাছে হাজারে আর লাখে তফাত কী বলো তো! কত টাকায় হাজার হয় তা-ই তো আজ অবধি জানলাম না। বললে ভুলই বলেছি। লাখ নয়, হাজার।”
একটা শ্বাস ফেলে পাগলু বলল, “তার মানে লোকটা তোকে খুনের কাজে লাগাতে চাইছে।”
“আহা, খুনটুন বললে ভাল শোনায় না পাগলুদাদা।”
“কেমন শোনায় জানি না। কিন্তু কাজটা খুনই, শোন, তোর সঙ্গে অনেক দিনের সম্পর্ক। তোকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখি। কিন্তু তোর মাথায় যদি
এসব পাপের চিন্তা ঢোকে তা হলে আর তোর ছায়াও মাড়াব না।”
জগা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “তা হলে কি চিরটা কাল ছিচকে চোরই থেকে যাবো পাগলুদাদা? জীবনে উন্নতি করতে পারব না?”
“চোর থেকে খুনি হওয়া কি উন্নতি রে পাগল? তোর ধর্মে কী বলে?”
“ফস করে ধর্মের কথা তোলো কেন বলো তো!”
“ধর্ম বলে একটা ব্যাপার আছে, তাই বলি, চুরিও অধর্ম কিন্তু জীবহত্যা ওরে বাপ রে!”
“হাসালে পাগলুদাদা। জীবহত্যা যদি পাপ হবে তবে পাঁঠা কাটলে, মাছ মারলে, মশা মারলে যা পাপ মানুষ মারলেও তার বেশি পাপ হওয়ার কথা নয়।”
পাগলু কাহিল মুখে একটু হেসে বলল, “তোর বুদ্ধি খুব খুলেছে রে জগা। বেশ বলেছিস। কিন্তু আমি ওর মধ্যে নেই। তোকে বলি, তুইও থাকিস। মশা মারলে ফাঁসি হয় না। কিন্তু মানুষ মারলে হয়, এটা তো মানিস!”
“ফাঁসি হয়, ধরা পড়লে, ধরা না পড়লে কিছু হয় না।”
“ধরা পড়বি না কে বলতে পারে?”
“ভেবে দেখতে হবে।”
“লোকটাকে খুন করতে চায় কেন এই লোকটা?”
“তা অত খোলসা করে বলেনি। আন্দাজ করছি, বুড়ো মানুষটা এর মামা বা কাকা গোছের কেউ হয়। সে মারা গেলে এ-লোকটা সম্পত্তি পাবে।”
“বটে! তা দেশে কি খুনির অভাব? টাকা ফেললেই কত লোক গিয়ে খুন করে আসবে। লোকটা তোকে এ-কাজের জন্য বাছল কেন?”
“আমার মধ্যে নাকি মস্ত বড় হওয়ার মতো গুণ আছে। সেই দেখেই।”
“তোর মাথা।”
“তা হলে কী?”
“বলব? বললে বিশ্বাস করবি?”
“বলেই দ্যাখো না।”
“খুন যদি তুই করিসও লোকটা তোকে ফাঁসিয়ে দেবে। একটি পয়সাও আর পাবি না। উলটে ধরা পড়ে ফাঁসিতে যাবি। লোকটা তোকে বলির পাঁটা করেছে।”
শুনে একটু ছাইবর্ণ হয়ে গেল জগা, বলল, “তাই নাকি পাগলুদাদা?”
“তাই তো মনে হচ্ছে।”
“কিন্তু কাজটা যদি না করি তা হলে যে লোকটা পুলিশের কাছে যাবে। তার কাছে আমার সব অপকর্মের একটা ফর্দ আছে।”
“তা থাক। তুই বরং পালা।”
“পালাব! কোথায় পালাব?”
দু’জনের যখন এরকমতরো কথা হচ্ছে, কারোই কোনও দিকে খেয়াল নেই, তখন হঠাৎ পেছনের বাবলা ঝোঁপের আড়াল থেকে বেঁটেখাটো একটা লোক বেরিয়ে এসে বলল, “ওঃ, তোমাকে খুঁজে খুঁজে যে হয়রান হলাম হে জগা!”
লোকটার গায়ে সবুজ জামা। দুজনে হাঁ করে চেয়ে রইল।
.
০৯.
গোপেশ্বরকে দেখে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। হরিপুরে আজ হাটবার, আর হাটবারে কে না হাটে আসে! তবে জগা আর পাগলু একটু ঘাবড়ে গেছে, যদি গোপেশ্বর তাদের কথাবার্তা শুনে থাকে! খুন-খারাপি নিয়ে কথাবার্তা তো ভাল নয়।
গোপেশ্বরের মুখ দেখে তার মনের ভাব বুঝবার উপায় নেই। ভারি অমায়িক মুখে মিষ্টি একটু হাসি। মোলায়েম গলায় বলল, “তা ভায়াদের যে মুখ বড় শুকনো দেখছি! এ তো ভাল কথা নয়। মায়াবদ্ধ জীব তো মনের ঘানিতে ঘুরবেই। বেঁচে থাকা মানেই পাকে-পাকে জড়িয়ে পড়া। তা কথাটা হচ্ছিল কী নিয়ে?”
জগার মুখে বাক্য সরল না। পাগলু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “এই দ্রব্যগুণ নিয়েই কথা হচ্ছিল আজ্ঞে।”
“দ্রব্যগুণ! বলো কী হে? দ্রব্যগুণ নিয়ে তো মাথায় ঘামায় রামহরি কবিরাজ।”
পাগলু জিভ কেটে মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলি! দ্রব্যগুণ বলতে জিনিসপত্রের দামের কথাই হচ্ছিল আজ্ঞে। কুমড়োর দাম কী চড়াটাই চড়েছে বলুন তো! মুলো বলুন, শাকপাতা বলুন, কোনটা গরিবের নাগালে আছে বলতে পারেন?”
“তা বটে। তা হলে দ্রব্যগুণ নিয়েই কথা হচ্ছিল তোমাদের?”
“যে আজ্ঞে।”
“আমার বয়স হয়েছে। কানেও ভাল শুনি না। তবে যেন ঝোঁপের আড়াল থেকে মনে হল, কারা যেন খুন-খারাপি নিয়ে কথা কইছে।”
পাগলু একগাল হেসে বলল, “খুনই তো, খুন ছাড়া একে আর কী বলা যায়? এই জগা বলছিল, “পাগলুদাদা, জিনিসপত্রের যা গলাকাটা দাম দেখছি এতে গরিবেরা সব খুন হয়ে যাবে।”
“বটে। তা ঠিক কথাই তো!”
“আজ্ঞে, নিয্যস কথা। তা আপনি কিছু কইবেন?”
“গোপেশ্বর মিষ্টি হাসিটি বজায় রেখেই বলল, “সেইজন্যেই তো হাটময় খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাদের হে। এসো, এই গাছতলায় জুত করে বসি। কথা আছে।”
“জগা খুবই ভয় পেয়েছে। বসতে গিয়ে সে দেখল তার হাতে-পায়ে খিল ধরে কেমন শক্ত হয়ে গেছে। হাঁটু ভাঁজ হতে চাইছে না। সে বলল, “আপনারা কথা বলুন, আমি একটা কচু দর করে এসেছি, দেখি গিয়ে সেটা আবার কেউ নিয়ে গেল নাকি।”
গোপেশ্বর মিষ্টি গলায় বলল, “কচুর জন্য ভাবনা কী হে? আমার বাড়ির পেছনেই মেলা হয়েছে। দাম দিতে হবে না, অমনি দিয়ে দেবখন তোমাকে একটা, আর কথাটাও তোমার সঙ্গেই কিনা।”
জগা বলল, “আজ আমার সঙ্গে অনেকেরই কথা আছে দেখছি।”
গোপেশ্বর মাথা নেড়ে বলে, “যা বলেছ, মানুষ নিজের গুণেই বড় হয় কিনা! আর বড় হওয়ার ওইটেই রাজলক্ষণ। তখন সবাই তাকে খোঁজে, একটু আগেই তো দেখছিলাম যেন একজন লম্বা দশাসই চেহারার লোক খালধারে দাঁড়িয়ে তোমার কাঁধে হাত রেখে কথা কইছিল!”